স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং তারুণ্যের বাংলাদেশ

একটি পতাকা। একটি মানচিত্র। ৫৬ হাজার বর্গমাইল সবুজ ভূমি। ৭ কোটি মানুষের স্বদেশ ফিরে পাবার বাসনা। দুইশ বছরের শোষণ থেকে মুক্তির আহাজারি। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা খোকন সোনাদের স্বদেশ প্রেম। বিজয়ের অদম্য স্পৃহা। অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়া। ৯ মাস যুদ্ধ। লাখো মা-বোনের ইজ্জত আর অবুঝ শিশুর নিষ্পাপ প্রাণের বিসর্জন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রাঙানো সবুজ ভূমি। লাল হলো পতাকা। শত্রুর পিছুহট। বিজয় আমাদের এসেছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই। শতশত বছরের ইংরেজ শোষণ থেকে মুক্তি পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের রোষানল থেকে মুক্তি পায়নি বাঙালি। সামরিক শক্তির দম্ভে এদেশবাসীদের প্রজা হিসেবে গণ্য করে পাকিস্তানিরা। আর সে প্রভুসুলভ মানসিকতা থেকেই তারা মুক্তি ও সমঝোতার সব পথ পরিত্যাগ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শাসকদের নির্দেশে বর্বর পাকিস্তান সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালির উপর। সেদিন নিরীহ নিরপরাধ মানুষের নৃশংস হত্যার ঘটনায় শিউরে ওঠে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ। তাদের এই অনাচার এ জাতি নীরবে সহ্য করেনি। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নরম পলিমাটির দেশের কোমল বাঙালি ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে। প্রতিরোধের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছে। নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে এদেশের মানুষ কারও কাছে মাথানত করতে জানে না। গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে চায় না। শত বাঁধার প্রাচীর ডিঙাতে পারে তবু কোথাও থেমে যেতে পারে না। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার দিক-দিগন্ত হতে বাংলা মাটির বীর সেনারা বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আজকাল প্রায় শুনিÑ মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের নাকি কোনো অবদান নেই। তা হয় কিরে? একাত্তরে ধর্মপ্রাণ জনতার বিরাট অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। ধর্মের নাম ভাঙিয়ে যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল তারা ছিল ধর্মের নামে অতিক্ষুদ্র গোষ্ঠী। একাত্তরে তাদের সংখ্যা দেশের মোট মুসলিমের ০.৫ শতাংশও ছিল না। তাই তাদের দোহাই দিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধে চেতনার মূলভিত্তি থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়া ধর্মবিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধ কোনো সামরিক সমর ছিল না। এটা ছিল এক সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কোটি কোটি নিরস্ত্র-ভূখা-মেহনতি জনতার এক অসম লড়াই। আল্লাহর রহমত না থাকলে এমন অসম লড়াইয়ে এ জাতির পক্ষে বিজয় লাভ সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার বক্তব্যে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে বলেছিলেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, তবু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।

এ দেশের ধর্মপ্রাণ, নবীপ্রেমী লাখো জনতা ছিল বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। ইমাম মুয়াজ্জিনরা শুধু মসজিদেই তাদের দায়িত্ব পালন করেননি বরং এক হাতে তসবিহ্ আরেক হাতে অস্ত্র নিয়ে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে দেশের লাল-সবুজের পতাকার জন্য যুদ্ধে নেমেছিলেন। মাওলানা রহমতুল্লাহ নামের এক আলেমের কথাই বলি, যিনি ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ মতিয়ালপুল জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। সেই ইমাম রহমতুল্লাহ্ সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের সমরাস্ত্রসমূহ নিরাপদে জমা রাখতেন এবং অপারেশনের সময় সেই অস্ত্র আবার মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। এমনকি নিজের খাবার মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে নিজে অনাহারে দিনাতিপাত করতেন। এমন বহু আলেম মুক্তিযোদ্ধার অবদানের কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়নি।

স্বাধীনতার ৫০ বছর খুব কাছেই। আমাদের স্বপ্ন ছিল বিশাল। প্রত্যাশা ছিল দিগন্ত প্রসারী। ইচ্ছে ছিল স্বাধীন দেশটা স্বাধীনভাবে সাজাব অপরূপ সাজে। আমাদের মাতৃভূমি সবুজ-শ্যামল এই বাংলা হয়ে উঠবে একটি স্বপ্নপুরী। জাতি হিসেবে আমরা আসীন হবো শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্নের ঘোর কেটে যায় সহসাই। সব স্বপ্ন হয়ে যায় ধূসর। পেরিয়ে এসেছি বিজয়ের ৪৬ বছর। এখনো স্বদেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে। এখনো এদেশ অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত। দরিদ্র্যতার যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে বহু মানুষ। ন্যূনতম চিকিৎসার অভাবে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে অসংখ্য লোক। পুষ্টিহীনতা ভুগছে লাখো হতভাগ্য শিশু। মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি আজও নিশ্চিত হয়নি। স্বাধীনচেতা মানুষ আজও পারেনি স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে। সন্তানহারা মা পায়নি তার সন্তানের রক্তদানের প্রতিদান। তাহলে কি পেলাম এই স্বাধীনতায়? এই প্রশ্ন, স্বাধীন স্বাধীন বলে গালা ফাটানো সেই জনতার বিবেকের কাছে ছেড়ে দিলাম। দেশ গড়ার নতুন প্রত্যয়ে আমাদের পথচলা শুরু করতে হবে। আমরা যারা তরুণ কিংবা উচ্ছ্বাসিত যৌবনের অধিকারী তাদেরকেই এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। দেশ ও জাতির শেষ ভরসাস্থল হলো নতুন প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মের হাতেই নির্মিত হবে জাতির ভবিষ্যৎ।