ধানক্ষেত, সবজি বাগান, একটু এগিয়ে গেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুলের সামনে শহীদ মিনার, নদী, ব্রিজ, গ্রাম্য বাজার, ডিজিটাল ইউনিয়ন পরিষদ, মোবাইল ব্যাংকিং-মানি একচেঞ্জের দোকান, পাড়ার মোড়ের ছোট্ট মুদির দোকান আর দোকান লাগোয়া মোসলেম গাজীর চায়ের দোকান। আমাদের চিরচেনা গ্রামের এমন দৃশ্য এখন শোভা পাচ্ছে রাজধানীর বুকে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) চলছে পাঁচ দিনব্যাপী ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সম্মেলন। আর সেই সম্মেলনে বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের গ্রামকে এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে; সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে ঐতিহ্যকেও।
নিরাপত্তা বেষ্টনী শেষে দু’পা এগোলেই চোখে পড়ল ভ্রাম্যমাণ আইসিটি সেন্টার। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বিশালকায় বাসটির সামনে এক সারিতে সাজানো রয়েছে শিশুদের স্কুলের কালো জুতা। ভেতরে শিশুরা আইসিটি সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত। ওদের মনোযোগ বিঘিœত না করেই এগিয়ে গেলাম মূল মেলা প্রাঙ্গণের দিকে। চোখে পড়ল কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি বাড়ি-উঠোন, পুকুর। পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে, পুকুরপাড়ে সবজির মাচা, কবুতরের ঘর, এরই পাশে বসন্ত রানী পাল ও হরিপদ পাল মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত। হরিপদ পাল জানান, বাপ-ঠাকুদার পেশা ছিল। আমিও তাদের কাছেই শিখেছি। এ কাজ করেই সংসার চালাচ্ছি। খানিকটা মলিন মুখে বসন্ত রানী জানান, আমার ছেলেরা কেউ এ পেশায় আসেনি। তার পেছনেও রয়েছে যৌক্তিক কারণ। তবে হরিপদ বললেন, এগুলো বাংলার ঐতিহ্যের অংশ। সে কারণেই এগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এত গেল দেশের মানুষের জীবনযাপন উন্নয়নের একটি চিত্র। অপরদিকে দেখা গেল দেশের স্বনির্ভরতা অর্জনের মূল চাবিকাঠি। যেসব খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কারণে দেশের উন্নয়ন আজ আর বিদেশি ঋণের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না। বাংলাদেশের উৎপাদিত রফতানিযোগ্য বিভিন্ন পণ্যের সমাহারসহ রয়েছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নৃ-তাত্ত্বিক নিদর্শন ও সংস্কৃতির প্রদর্শনী। আর এসব কিছুই তুলে রয়েছে আইপিইউ সম্মেলন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত মেলায়। মেলার আয়োজন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। আইপিইউ সম্মেলন উদ্বোধনের দিন ১ এপিল বিকালে এ মেলার উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। আয়োজকরা জানান, মেলায় রয়েছে চারটি প্যাভিলিয়নসহ সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৫৯টি স্টল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিযোগ্য খাত তৈরি পোশাক শিল্প, পাটজাত পণ্য, সিল্ক শিল্প, ওষুধ শিল্প, চামড়াজাত শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প, অলংকার সামগ্রী, চা, তাঁত, টেরাকোটা, মৃৎশিল্প, মিষ্টি, খাদ্যসামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, দেশীয় কুটির শিল্প, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি, ফার্নিচারসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। প্রদর্শনীর পাশাপাশি কেনাকেটারও ব্যবস্থা রয়েছে বেশকিছু স্টলে। এছাড়া রয়েছে আইসিটি প্রদর্শনী, গণপূর্ত বিভাগের পরিকল্পিত শহর-মডেলসহ পর্যটন ইত্যাদি।
মেলায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন স্টলের প্রতিনিধিরা জানান, সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকে। সারা দিন বিভিন্ন সেশনের মাঝে মধ্যে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি প্রতিনিধিরা মেলায় আসছেন, ঘুরে দেখছেন। সিল্ক হাউসের বাংলাদেশের মানচিত্র ও বাংলা বর্ণমালা খচিত টাই, ছোট হাতব্যাগ (পার্স) স্যুবিনির, প্রিয়জনের জন্য উপহার কিংবা নিজের জন্য কেনাকাটাও করছেন অনেকেই। তারা আরও জানান, উগা-া ও নাইজেরিয়ার প্রতিনিধিরা বেশি কেনাকাটা করছে। নারী উদ্যোক্তা পুরবী জানান, আমাদের এখানে সব গ্রাম্য নারীদের উৎপাদিত দেশীয় পণ্য নকশিকাঁথা, হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের জুয়েলারি, আদিবাসীদের তাঁতে বোনা পোশাক বিক্রি হচ্ছে। তানজিয়নিয়ান পুডানচিয়ান কিক্ওয়েন আদিবাসীদের তৈরি পোশাক কিনতে পেরে ভীষণ খুশি। তিনি বললেন, আমি নিজেই এটি ব্যবহার করব। চামড়াজাত শিল্প অ্যাসোসিয়েশনের স্টলের বিক্রেতা বিস্ময় সাহা জানান, আয়ারল্যান্ডের স্পিকার ও’ডোনোভান ভেনিস এসেছিলেন আমাদের স্টলে। ভেনিস অবাক হয়েছেন এখানকার চামড়াজাত পণ্যে গুণগতমান আর ডিজাইন দেখে।
ডেনমার্কের এক প্রতিনিধি বেশ উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশী পণ্যের মূল্য দেখে। তিনি জানান, একবার জার্মানি থেকে বাংলাদেশী একটি তোয়ালে কিনেছিলেন ১৫ ইউরোতে, সেই একই মানের তোয়ালের দাম এখানে দেখছেন মাত্র ৫ থেকে ৯ ডলার। টি-শার্ট, জিনস্ প্যান্টের মূল্যের ক্ষেত্রেও এমন পার্থক্য তিনি খেয়াল করেছেন। আবার কিছু পণ্য রয়েছে যেগুলো এখানে দেখছেন; কিন্তু বিশ্বের অন্য দেশে সচরাচর পাওয়া যায় না বলেও জানান বেশ কয়েকজন বিদেশি প্রতিনিধি। আবার ভারত, শ্রীলংকাসহ যেসব দেশে শাড়ি পরা হয় তারা যেমন পরার জন্য কিনছেন ঢাকার জামদানি। অন্য দেশের কেউ কেউ আবার জামদানি বা বেনারসি কিনছেন ঘর সাজাবার সামগ্রী হিসেবে।
মেলায় রফতানিযোগ্য পণ্যগুলোর মধ্যে সম্ভাবনাময়ী বেশকিছু পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরামিক, ওষুধ ইত্যাদি। সিরামিক পণ্যের প্রদর্শনী নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করেছে সাইনপুকুর লিমিটেড। সাইনপুকুর সিরামিকসের লোকাল মার্কেটিং কর্মকর্তা শাহিদ ইকবাল জানান, বাংলাদেশের সিরামিক পণ্য বর্তমানে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে রফতানি হচ্ছে। তিনি বলেন, এ শিল্পে বৈদেশিক মুদ্রার্জনে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও জানান, কেবল সাইনপুকুর নয়, মন্নু, ফারসহ বেশকিছু কোম্পানি বিদেশে সিরামিকস পণ্য রফতানির মাধ্যমে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মেলায় স্থান স্বল্পতার কারণে অন্যরা প্রদর্শনীতে আসতে পারেননি। মেলার আয়োজক ক্রিয়েটো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের রাকিবুল হাসান বলেন, মেলায় চারটি টেন্টসহ ছোট-বড় ৫৯টি স্টল রয়েছে। অসুস্থ হলে রয়েছে ডাক্তারের ব্যবস্থাও। আয়োজক কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এ মেলা চলবে। ১৩৬তম আইপিইউ সম্মেলনে আগত প্রতিনিধি, আমন্ত্রিত অতিথি ও গণমাধ্যম কর্মীরা মেলা পরিদর্শন করতে পারবেন। মেলায় মানি চেঞ্জিংয়ের ব্যবস্থাসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোঃ আবদুর রউফ জানান, আমরা এদেশের মানুষের জীবন-যাপনের মান তথা বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র বিশ্বের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে এ মেলার আয়োজন করেছি। আমরা মেলাটি খুব ক্ষুদ্র পরিসরে মাত্র ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুট জায়গার মধ্যে করেছি। এ মেলার মধ্য দিয়ে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ, বিশেষ করে রফতানি খাতে আরও উন্নতি লাভে এগিয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।