নতুন ভারসাম্য, নতুন সম্ভাবনা

ড. দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ভারত সফর করেন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববর্তী সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্কে সৃষ্ট তিক্ততার অবসান ঘটানো। শুধু তাই নয়, তিনি একান্ত ব্যক্তিগত চেষ্টায় দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়েরও সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। পরের বছরগুলোতে এ সম্পর্ক ক্রমাগত উন্নত হতে আমরা দেখেছি।

গত সাত বছরে বহু বছর ধরে অনিষ্পন্ন কয়েকটি সমস্যার সমাধান হতে আমরা দেখেছি। প্রথমেই বলতে হবে সীমান্ত চিহ্নিত ও ছিটমহল বিনিময়ের কথা। বিশ্বে অনেক দেশ রয়েছে, যারা স্থল ও জল সীমান্ত নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারছে না। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই দুটি দেশ এ বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করে। এর সঙ্গে ভূমি বিনিময়ের প্রশ্ন ছিল। বিষয়টি ভারতের পার্লামেন্টের গণ্ডি ছাড়িয়ে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই এর নিষ্পত্তি সম্ভব হয়। গত বছর জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে এ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

বাংলাদেশ মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানাও চিহ্নিত করতে পেরেছে। এ জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যাওয়া এবং তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রতিটি দেশই সম্মতি জ্ঞাপন করে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল; কিন্তু তারা যে রায় প্রদান করবে সেটা মেনে নেওয়ার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাও বড় ভূমিকা পালন করে। সে সময়ে ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস ও তার মিত্রদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ছিল।

দুটি দেশ ট্রানজিট সমস্যারও সমাধান করতে সক্ষম হয়। এ ইস্যুতে রাজনৈতিক বিরোধিতা ছিল। কিন্তু উভয় দেশের নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা প্রদর্শন করতে পারে। ফলে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির আওতায় এ সমস্যার সমাধান হয়। এ প্রক্রিয়ায় নেপাল ও ভুটানকেও যুক্ত করা সম্ভব হয়, যা ভবিষ্যতে মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। আমদানি বাণিজ্যে তারা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে, চীনের পরেই। ভারতে আমাদের রফতানি কম, আমদানি অনেক বেশি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রফতানি বাড়ছে। সীমিত কিছু পণ্য বাদে ওই বিশাল বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের জন্য শুল্ক সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

ভারত সরকারের নিরাপত্তা বিষয়ে দীর্ঘদিনের কিছু উদ্বেগও শেখ হাসিনার সরকার সমাধান করতে পেরেছে। দুঃখজনকভাবে, ভারতের কিছু গোষ্ঠীকে আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ভারতের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য দশ ট্রাক অস্ত্রের একটি চালান পরিবহনে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধা ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্নম্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত যাবতীয় উদ্বেগ প্রশমিত করতে পেরেছেন।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও দুই দেশের সহযোগিতা বেড়ে চলেছে। ভারত থেকে আমরা বিদ্যুৎ আমদানি করছি। বাংলাদেশে বড় ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও ভারতীয় বিনিয়োগ আসছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ভারতের জনগণও গুরুত্ব দেয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, সেখানকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক সবচেয়ে নির্ভরশীল দেশের তালিকার শীর্ষে রেখেছেন বাংলাদেশকে। এক সময়ে এ আস্থার স্থানটি ছিল রাশিয়ার। এখানে আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। ভারতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় এসেছে ২০১৪ সালের মে মাসে। তখন কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেছিলেন যে, এ সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের বোঝাপড়া কেমন হবে। কিন্তু দ্রুতই এ প্রশ্নের উত্তর মেলে_ নরেন্দ্র মোদির সরকার দ্রুততার সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বাণিজ্য সম্পর্ক প্রসারিত হয়। কেবল একটি ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই_ ২০১১ সালে ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরকালে তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কথা ছিল। সে সময়ে জানা গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির সরকারের এতে প্রবল আপত্তি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে যে সমঝোতা হয়েছে তা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবারের সফরে কি তার সফল রূপায়ণ আমরা দেখতে পাব_ এ প্রশ্ন অনেকের।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর শুরু হচ্ছে ৭ এপ্রিল। তিস্তার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নতুন করে সামনে এসেছে_ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাবাহিনীপ্রধানের বাংলাদেশ সফর এবং ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে লেখালেখি ও আলোচনার কারণে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা হতেই পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রয়েছে। ভারতের সঙ্গেও নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতা রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীতে প্রশিক্ষণ বিনিময় চলছে। তথ্য বিনিময় হচ্ছে। যৌথ মহড়া হচ্ছে। জঙ্গিবাদ দমনে দুই দেশ নানাভাবে সহযোগিতা করছে। বন্দি বিনিময়ের চুক্তি কার্যকর রয়েছে। এসব সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এর সঙ্গে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে ভারত কিংবা বাংলাদেশের সম্পর্ককে জড়িয়ে ফেলা ঠিক হবে না। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শিং জিয়াও পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ-চীন ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা নতুন গতি পায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন ক্রয় করেছে। আমাদের সমুদ্রসীমা এখন অনেক প্রসারিত। এর নিরাপত্তা জোরদারের জন্যই চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কেনা হয়েছে এবং তা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের নৌবাহিনীর অংশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে এখন যথার্থ অর্থেই ত্রিমাত্রিক বাহিনী বলা যায়। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এ ধরনের সামরিক সহযোগিতা অনেক বছর ধরেই চলছে। এটা ঠিক যে, চীনের সঙ্গে ভারতের একাধিক ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, যার সূচনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। আমাদের স্বাধীনতার জন্য ভারতের বিপুল সংখ্যক সৈন্য প্রাণ দিয়েছে। সে সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় এক কোটি নাগরিক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দশকের পর দশক এ সম্পর্ক বিকশিত হয়ে চলেছে এবং একাত্তরই মূল প্রেরণা। এ সম্পর্কের বিকাশে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাধা হবে না, এটাই আমরা মনে করি। তবে শেখ হাসিনার সরকারের জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো। আবার বাংলাদেশের রয়েছে দুটি দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরকালে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ৩৮ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ও বিনিয়োগ সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশ এ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে আগ্রহী। এটাও সবার জানা যে, শেখ হাসিনা বিচক্ষণতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করায় আন্তরিক এবং তাতে সফলতাও মিলছে। ভারত নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অনুধাবন করতে পারছে। তাদের এটাও নিশ্চয়ই উপলব্ধিতে রয়েছে যে, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক ভারতকে যেভাবে প্রভাবিত করতে পারে, বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্কে সেভাবে দেখা চলে না। কারণ পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক তিক্ততায় ভরা। তারা দশকের পর দশক রয়েছে যুদ্ধাবস্থানে। চীনকে নিয়েও ভারতের উদ্বেগ কম নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্কও তৃতীয় কোনো দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়। চীনের বিরুদ্ধে তো নয়ই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। এ সম্পর্ক বিকশিত করায় তিনি আন্তরিক। তিনি কূটনীতিতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন এবং তা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সব মহলকে এটাও মনে রাখতে হবে যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বসমাজ দেখছে। বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশের বৃত্ত অতিক্রম করে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের সারিতে অবস্থান করে নিয়েছি। এখন লক্ষ্য, মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে পেঁৗছানো। সমকালে ৩০ মার্চ অজয় দাশগুপ্ত ‘ইমার্জিং পাওয়ারের সঙ্গে বোঝাপড়া’ শিরোনামে উপসম্পাকীয়তে লিখেছেন :আমাদের সবার প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ফলপ্রসূ হবে এবং তাতে এমন কিছু অর্জিত হতে হবে, যা উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষা করে। দুই দেশের দুই শীর্ষ নেতা নিজ নিজ দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু নেই_ এটা স্বীকৃত। তিনি এ স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে যে কতটা সক্রিয় ও আন্তরিক; পদ্মা সেতু প্রকল্প তার সাক্ষী। এর প্রতিফলন দিলি্ল বৈঠকে ঘটবে_ এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ নিঃসন্দেহ।

এ প্রত্যাশা তো আমাদের সবারই।