সাধারণভাবে গ্রামে গেলে অতীতের তুলনায় এখন কৃষি মজুরের সংখ্যা অনেক কম দেখা যায়। তাই বলে গ্রামে অকৃষি খাতে মজুরের উপস্থিতি কমে গেছে এটা বলা যাবে না। বরং সেখানে রিকশা চালক-ভ্যানচালক মৎস্যও মুরগির খামার, ক্ষুদ্র ব্যবসা ইত্যাদি খাতে গরিব মানুষের কাজের বহুমুখীকরণ ঘটেছে ও তাতে নানা রকমের শ্রম নিয়োগ ঈর্ষণীয় ভাবে বেড়েছে। তাই বর্তমানে ‘ক্ষেত মজুর’ শব্দটি যথেষ্ট নয় গ্রামীণ মজুরই হবে আমাদের গ্রামীণ জীবনের প্রধান বিষয়।
তাই ‘ক্ষেত মজুর সমিতিকে’ গ্রামীণ মজুরের সমিতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করার সময় চলে এসেছে বলে মনে হয়। এর গভীর ও মৌলিক তাৎপর্য রয়েছে। তাই এই বিষয়টিকে হালকা করে না দেখে_ গভীর ভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। কিন্তু এই নতুন অবস্থা ক্ষেতমজুরদের অতীত জীবনের কি কোন পরিবর্তন আনেনি? নিশ্চয়ই এনেছে এবং সেটাও আমাদের বিবেচনায় আজ নিতে হবে। গবেষকরা বলছেন গ্রামে ভরা মৌসুমে বিশেষভাবে এবং সাধারণভাবে বর্তমানে কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির বাজার বেশ অাঁটোসাটো হয়ে গেছে। কৃষি কাজের জন্য সহজে মজুরী শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য কৃষকরা ক্রমশ যান্ত্রিকীকরণের দিকেও ঝুঁকছেন। বর্তমানে কৃষকরা ফসল কাটা ও রোয়ানোর মৌসুমে ক্ষেতমজুদের সংগে ‘পিস বেট’ বা ‘কন্ট্রাক্টে’ যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা এখন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। আগের মত এখানে মালিকের পেছনে শ্রমিকরা ঘুরছেন না, মালিকরাই তাদের পেছনে ঘুরছেন।
পুরুষ শ্রমিকের ঘাটতিব কারণে কৃষকরা ক্ষেতে নারী শ্রমিক নিয়জিত করছে। কারণ তাতে তাদের সুযোগ ব্যয়ও (opportunity cost) কম এবং তাদেরকে মজুরি কম দিলেও চলে। তবে পোশাক শিল্পের সাম্প্রতিক বিকাশের কারণে গ্রামের দরিদ্র ও প্রান্তিক চাষি পরিবারের তরুণী মেয়েরাও এখন গ্রামের কৃষি খাতের কাজে থাকছেন না। পাশাপাশি অনেক সক্ষম অদক্ষ শ্রমিকও প্রচুর পুঁজি ভাঙিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছেন। এই সকল সম্মিলিত কারণে গ্রামের কৃষি খাতে আগের মত অঢেল শ্রম সরবরাহ নেই। বিশ্ব ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানও এখন বলতে শুরু করেছে যে, গ্রামে এখন আর ছদ্মবেশী বেকারত্ব নেই। আমরা এখন তথাকথিত Lewis Turning Point প্রান্তে উপনীত হয়েছি। সর্বশেষ হিসাবে গ্রামে এখন প্রতিবছর প্রায় ৮০০০ কোটি টাকার অনুঋণ ঘুরপাক খাচ্ছে। আগে এটা এতটা ছিল না।
এই নতুন পটভূমিতে আমরা কিভাবে ক্ষেতমজুর সমিতির আন্দোলনকে পুর্নগঠিত করবো, কোন বিন্দুতে তার ‘ফোকাস’ নির্ধারিত হবে, অতীতের তুলনায় কোথায় কোথায় আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে এবং নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে সেটিও আজকের অন্যতম বিবেচ্য। কারণ শেষ বিচারে গ্রামেই যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বসবাস এবং তাদের মধ্যে ভূমির মালিকানা বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই কোথাও না কোথাও শ্রম নিয়োগ করে বা শ্রমশক্তি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে, সেহেতু তাদের জীবনের উন্নতি ছাড়া দেশের কোন উন্নতি সম্ভব না। দেশের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় গ্রামের এই শ্রমজীবীরাই হবে শহরের শ্রমিক শ্রেণীর ঘনিষ্ঠতম মিত্র। তাই এই দুই মৌলিক শ্রেণীকে সংগঠিত করার এবং তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মৈত্রীবন্ধন স্থাপন করার দায়িত্বটি ‘বিকল্প’ গড়ে তোলার মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
কিছু পরিসংখ্যান
ওপরের বক্তব্যের সমর্থনে গবেষকদের গবেষণা থেকে প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো। এক নং তালিকায় কৃষিখাতে নিয়োজিত মজুরদের অর্থাৎ ট্র্যাডিশনাল ক্ষেতমজুরদের টাকায় এবং চালের পরিমাণে মজুরির দীর্ঘকালীন গতি প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭৯-৮০ পর্যন্ত তথ্য সংগৃহীত হয়েছে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এ.আর.খানের প্রবন্ধ Real Wages of Agriculture in B.D. (E.P.W., vol-19, no-4, Jan-28, 1984) থেকে। আর তার পরের তথ্যটি স্ট্যাটিস্টিকাল পকেট বুক (ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিক্স) ২০১৩ থেকে সংগ্রহ করে টাইম সিরিজের সঙ্গে সমতুল্য করে উত্থাপন করা হয়েছে। আরো পরের তথ্যও নেওয়া যেত। কিন্তু তাতে মূল প্রবণতার কোন হের-ফের হোত না।
তালিকা -১
কৃষি মজুরের মজুরির দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা
তালিকা ১ থেকে এ কথা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ক্ষেতমজুরদের মজুরি ছিল সাধারণভাবে ক্রমহ্রাসমান। সবচেয়ে কম মজুরী পেয়ে ব্যাপক মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন তারা ১৯৭৪-৭৫ এর দুর্ভিক্ষের সময়। ১৯৮০ তেও গ্রামীণ মজুরদের দৈনিক মজুরীর মাত্রা ছিল মাত্র ২.১৬ কেজি চাল। সে সময় সদ্য গঠিত ক্ষেতমজুর সমিতি সাড়ে তিন কেজির সমান মজুরির সেস্নাগানটি শ্রম বাজারে নিয়ে এসেছিল। যদিও মজুরি প্রশ্নে তখন মূল লড়াইটি হয়নি। মূল লড়াইটি সংগঠিত হয়েছিল প্রধানত খাস জমি খাস পুকুর গম চুরি বন্ধ এবং মজুরির দাবিতে। বিশেষ করে খাস জমি ও খাস পুকুর দখল করার জন্য তখন অনেক রক্তক্ষয়ী লড়াই বিভিন্ন জায়গায় বিকশিত হয়েছিল। ক্ষেতমজুর সমিতির বীর সদস্যরা শহীদ হতেও তখন দ্বিধা করেননি। এদের মধ্যে শহীদ লখাই হাওলাদার, ফজর আলী, নিরঞ্জন টুলু, সোনা মিয়া উল্লেখ যোগ্য।
দুই নং তালিকাটি আমরা সংগ্রহ করেছি বাংলাদেশের এক নম্বর গ্রামীণ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. মাহাবুব হোসেন (ও আবদুল বায়েস) এর প্রণীত ুজঁৎধষ ঊপড়হড়সু ধহফ ষরাবষরযড়ড়ফং: ওহংরমযঃং ঋৎড়স ইধহমষধফবংযচ্ (২০১০) গ্রন্থ থেকে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে যদি পরিবর্তনের গতিধারায় কেউ দেখতে চান তাহলে এই বইটি হবে তার জন্য একটি ‘বাইবেল’। এই বইয়ের ৭৫ পৃষ্ঠায় গ্রামীণ সমাজে ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে যে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে তার (১৯৮৮-২০০৭ কালপর্বে) একটি কালানুক্রমিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।
তালিকা-২
গ্রামীণ পরিবারে ভূমি মালিকানার কাঠামো
উৎস_ মাহবুব হোসেন ও আবদুল বায়েস (২০১০) পৃঃ ৭৫
২নং তালিকা থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের গ্রামে পুরো ভূমিহীন (যাদের বসতবাটীও নেই) এবং কার্যত ভূমিহীন (যাদের সব মিলিয়ে ৫০ শতকের কম জমি রয়েছে) এধরনের পরিবারের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১৯৮৮ সালে ছিল ৪৭.৪ শতাংশ। ২০০৭ নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৯ শতাংশ। ড. আবুল বারকাতের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ Rural Land Market in Bangladesh: An Exploratory Study with the Poor and Marginalized People (2017) বইয়ের তথ্যানুযায়ি সংখ্যাটি বর্তমানে হবে ৬২ শতাংশ। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বাংলাদেশের গ্রামে ভূমিহীনরাই এখন নিঃসন্দেহে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের হাতে অল্প-স্বল্প বসতবাটী ও জমি যেটুকু আছে তার পরিমাণ হচ্ছে যথাক্রমে মোট জমির মাত্র ৪ শতাংশ (১৯৮৮), ৪.৮ শতাংশ এবং ১২.৫ শতাংশ। সুতরাং সর্বশেষ হিসাবে দেখা যাচ্ছে গ্রামের ভূমিহীনরা হচ্ছেন প্রায় ৬০ শতাংশ এবং তাদের হাতে জমি মাত্র ১২ শতাংশ। পক্ষান্তরে আমরা যদি গ্রামের সবচেয়ে বেশি জমির মালিক ধনী অংশটির দিকে তাকাই (যাদের জামি ৩ হেক্টর বা ৭.৫০ একরের কাছাকাছি বা তার চেয়ে বেশি) তাহলে দেখবো যে তাদের অনুপাত যথাক্রমে সমগ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাত্র ২.৯ শতাংশ (১৯৮৮), ২.৯ শতাংশ (২০০০) এবং ১.৮ শতাংশ (২০০৭)। অবশ্য আমরা যদি জমির পরিমাণের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো তাদের মালিকানাধীন জমির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২১.২ শতাংশ, ২৬.৩ শতাংশ এবং ১৯.৪ শতাংশ। সুতরাং বলা যায় সবশেষ সময়ে গ্রামের মুষ্টিমেয় ১.৮ শতাংশ পরিবারের হাতেই কেন্দ্রীভুত হয়েছে ১৯.৪ শতাংশ জমি। এই ভূমি মালিকানার চিত্রটি সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা কয়েকটি পরিবর্তনের কথা বলতে পারি। প্রথমত, বাংলাদেশের ভূমি মালিকানা বৈষম্য মেরুকরণের দিকে না গেলেও এখনও যথেষ্ট বৈষম্য মূলক। প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমিহীন বা কার্যত ভূমিহীনের হাতে রয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ জমি। অথচ ২ শতাংশেরও কম ধনী ভূস্বামীদের হাতে রয়েছে ১৯.৪ শতাংশ জমি।
মাহ্বুব হোসেন পরে দেখিয়েছেন এই ধনী ভূস্বামীরা ক্রমশ কৃষি থেকে অকৃষি, গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছেন। তাদের অনেক জমিই তারা মধ্য ও গরিব চাষিকে ভাড়া দিয়ে দিচ্ছেন। এই ভাড়া দানের জন্য ব্যবহৃত জমির ভাড়া ক্রমাগত বাড়ছে কারণ জমি ভাড়ার জন্য শুধু মধ্য চাষিরাই প্রতিযোগিতা করছেন তা নয়, ভূমিহীন গরিবরাও করছেন। যারা রেমিট্যান্সের নগদ অর্থ পাচ্ছেন তারাও এই জমি ভাড়া নেওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অনুঋন সংগ্রহ করে এক জায়গায় সম্মিলিত করে সন জমার শর্তে ভূমিহীন গরিবরাও জমি ভাড়া করে চাষে আত্মনিয়োগ করার চেষ্টা করছেন। সুতরাং যদিও এখনো গ্রামাঞ্চলে প্রধান চাষি পরিবারগুলো নিজের মালিকানাধীন জমিতে নিজেই চাষ করেন অর্থাৎ মালিক চাষিই রয়ে গেছেন, কিন্তু গতিশীল বিচারে দেখা যায় যে বর্গা ও নানাধরণের চুক্তি বর্গা নিয়ে মালিক-প্রজা (ঙহিবৎ ঈঁস ঞবহধহঃ) বা নিখাদ প্রজাদের (চঁৎব ঞবহবহঃ) সংখ্যা ও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন জমিও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাহ্বুব হোসেন প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৮ সালে নিখাদ প্রজার (চঁৎব ঞবহধহঃ) বা প্রজা- মালিক (ঞবহধহঃ ঈঁস ঙহিবৎ) বা মালিক- প্রজাদের (ঙহিবৎ ঈঁস ঞবহধহঃ) সংখ্যা ছিল ৪৪ শতাংশ এবং তাদের হাতে চাষাধীন জমি ছিল মোট জমির ৪২ শতাংশ। পক্ষান্তরে নিখাদ মালিক চাষিদের সংখ্যা ছিল ৫৬ শতাংশ ও তাদের আবাদকৃত জামির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৮ শতাংশ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালে এসে আমরা দেখব যে নিখাদ মালিক চাষির আপেক্ষিক গুরুত্ব হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৪৯ শতাংশ। তবে মালিক চাষিদের আবাদকৃত জমির আপেক্ষিক গুরুত্ব কমেওনি বাড়েওনি। সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি গ্রামে এখন জমি ভাড়া নেওয়া-ভাড়া দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। এমনকি শহর থেকে ঈড়হঃৎধপঃ ঋধৎসরহম জন্যও ধনী লোকেরা গ্রামে যাচ্ছেন এবং জমি ভাড়া নিচ্ছেন, কিনে নিচ্ছেন, জবধষ ঊধংঃব তৈরি করছেন, আবার অনুপস্থিত ভূস্বামী হিসাবে জমি ভাড়াও দিচ্ছেন ইত্যাদি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে জমির ক্ষেত্রে অতীতে যে ‘বর্গা’ (যাকে আমরা আধা সামন্তবাদ বা সামন্তবাদের অবশেষ বলে অনেকদিন ধরে অভিহিত করেছি) প্রথা চালু ছিল তা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এক হিসাবে দেখা যায় ১৯৮৮ সালে জমি আদান প্রদানের ৭২ শতাংশ ট্র্যানজ্যাকশন বর্গার অধীনে পরিচারিত হোত, পক্ষান্তরে খাই-খালাসী, চুক্তি, মর্টগেজ, ইত্যাদি অবর্গা পদ্ধতিতে ট্র্যানজ্যাকশনের আপেক্ষিক গুরুত্ব ছিল মাত্র ২৮ শতাংশ। কিন্তু ২০০৭ এ দেখছি জমি হস্তান্তরের ট্র্যানজাকশনে বর্গা পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে ৫৯ শতাংশ কেসে অর্থাৎ তা হ্রাস পেয়েছে। আর অধর্গা পদ্ধতির ট্র্যানজাকশন হয়েছে ৪১ শতাংশ কেসে অর্থাৎ তা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং গ্রামাঞ্চলে কার্যকর শক্তিতে পরিণত হতে হলে দরিদ্র ভাড়াটে বা বর্গাচাষিদের যেসব সমস্যা যেমন বর্গার/চুক্তির শর্ত, বর্গার/চুক্তির নিরাপত্তা, কৃষি ঋণ, উপকরণের দাম, ফসলের দাম, জলসেচ, ফসল বীমা, এসব দিকেও এখন নজর দিতে হবে।
আরো কিছু অভিজ্ঞতা
এটা বিশেষভাবে জরুরি হয়ে উঠেছে এজন্য যে ভূমিহীন দরিদ্র চাষি ও কম জমির মালিক প্রান্তিক চাষিরা এসবকে আশ্রয় করেই টিকে থাকতে বা বেঁচে থাকতে চাইছেন। আর ধনীরাও শহরের আকর্ষণে এবং কৃষিতে লাভের ঘাটতি, কৃষির ব্যবস্থাপনা সংকট, কৃষি শ্রমিকদের অসহজ লভ্যতা, ইত্যাদি কারণে জমি ভাড়া/বর্গা দেয়ার দিকে ঝুঁকছেন। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত চাষির অধিকার স্থায়ী করে, লাঙল যার জমি তার এই নীতির ভিত্তিতে কি ভাবে জমির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করতে পারি তা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। রাজনৈতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য এবং সৃজনশীল কৃষি সংস্কার কর্মসূচির কথা ভাবতে হবে। ভাবতে হবে দখলকৃত এবং বেদখলকৃত খাস জমি ও খাসপুকুরের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের কথাও। তার জন্য উপযুক্ত সংগঠনবিধিও খুঁজে বার করতে হবে।
আমরা যদি আজকের আলোচনার ইপ্সিত অন্যতম দুটি গ্রামীণ শ্রেণী/স্তরের দিকে তাকাই_’ভূমিহীন’ ও ‘ক্ষুদে চাষি’ তাহলে দেখবো তাদের অর্থনৈতিক পেশার বিন্যাসে ১৯৮৮-২০০৪ কালপর্বে উল্লেখযোগ্য মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে ভূমিহীনদের ৬৪ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত ছিল। এদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই কৃষিতে ক্ষেতমজুর হিসাবে কাজ করত। বাকিরা জমি ভাড়া/বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতো। ২০০৪ এ দেখা যাচ্ছে ভূমিহীনদের মধ্যে মাত্র ৪৭ শতাংশ কৃষিতে কাজ করছেন। ৫২ শতাংশই এখন আর ক্ষেতমজুর নন, তারা নানা ধরনের অকৃষি কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। এই ৫২ শতাংশের অর্ধেক অকৃষি খাতে মজুরি শ্রমিক হয়েছেন, বাকি অর্ধেক নানাধনের ব্যবসা ও চাকরিতে নিয়োজিত হয়েছেন। এছাড়া প্রান্তিক চাষিদের পেশার ক্ষেত্রেও দেখা যাবে ১৯৮৮ সালে যে জায়গায় মাত্র ২০ শতাংশ অকৃষি এবং ৮০ শতাংশ কৃষি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন, ২০০৪ সালে সে জায়গায় ৪১ শতাংশ অকৃষি এবং ৫৯ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছেন। এসব পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিতে হলে আমাদের গ্রামীণ মজুরদের ও ক্ষুদ্রে চাষিদের যে বড় অংশটি অকৃষি খাতে চলে এসছে তাদের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। অর্থাৎ গ্রামীণ মজুরদের মধ্যে যারা এখনো মূলত অকৃষি মজুর তাদের আন্দোলনের ধারাটিও সঠিকভাবে নির্নয় করতে হবে। সম্প্রতি ওখঙ প্রস্তাবিত শ্রম আইন অনুসারে গ্রামীণ মজুরদের নির্বিশেষে শ্রমিক হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইগত স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই স্বীকৃতিকে ব্যবহার করে শহরের ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের মডেলটির সৃজনশীল গ্রামীণ রূপ বা প্রয়োগ সম্ভব কি না_ তাও বামপন্থিদের ভেবে দেখা দরকার।
আরো কতিপয় ইস্যু
সম্প্রতি সরকার গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য দুরীকরণের লক্ষ্যে প্রায় ১৫০ এরও বেশি নানা টাগের্ট গ্রুপ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এককালে গ্রামে-গঞ্জে গমের বিনিময়ে কাজ হোত এবং অতীতে ক্ষেতমজুর সমিতি ন্যায্য মজুরীর দাবিতে এবং গম চুরি ঠেকাতে বহু জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এক পর্যায়ে এই খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার জন্য ক্ষেতমজুর সমিতি দাবি করেছিল যে প্রতিটি প্রকল্প এলাকায় প্রকল্প সংক্রান্ত সকল তথ্য সম্বলিত সাইন বোর্ড থাকতে হবে। এই দাবি কোথাও কোথাও আদায় হয় এবং ওই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তখন বহুজায়গায় ক্ষেতমজুর নেতৃবৃন্দ ন্যায্য পাওনা আদায় করে নিতেও সমর্থ হয়। এখন এসব সামাজিক নিরাপত্তা জালের ন্যায্য পাওনা প্রসংগে গ্রামীণ মজুরদের ভাবতে হবে এবং করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনকে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকলে তা কাজে লাগাতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। আগেই বলেছি গ্রামীণ মজুররাই গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তারা যদি শ্রেণী সচেতন হন এবং ঐক্যবদ্ধ হন তাহলে তারাই তাদের নেতৃত্বে অন্য মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামীণ স্থানীয় নির্বাচনী সংস্থাগুলো দখল করে নিতে পারেন। এতে একদিকে যেমন সরকারি হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বর্তমানে যে দলীয় লুটপাট হচ্ছে তা ঠেকানো সম্ভব হবে অন্যদিকে গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতা কাঠামোও আরো গণতান্ত্রিক, আরো ধর্মনিরপেক্ষ, আরো প্রগতিশীল হয়ে উঠবে। এভাবে শ্রেণীকে সামনে এনে পশ্চাৎপদ সাম্প্রদায়িক ধ্যান ধারণাকেও আঘাত করা ও কার্যকরভাবে পরাজিত করা সম্ভব হবে।
আরো কিছু অভিজ্ঞতা
গ্রামীণ মজুর, বিশেষ করে ক্ষেতমজুররা শত শত বছর ধরে দাস শ্রমিক হিসেবে বেঁচে ছিল। আশি্বন-কার্তিক মাসে ক্ষুধার তাড়নায় তাদের ১৫-২০ টাকায় তাদের অগ্রিম শ্রম বিক্রি করতে হতো। অথচ মৌসুমে মজুরির বাজার থাকতো ৬০-৭০ টাকা। মঙ্গায় না খেয়ে মারা পড়তো। ১৯৮১ সালের ১৮ মার্চ বাংলাদেশ ক্ষেত মজুর সমিতি প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৩৬ বছরে এই শ্রেণীর আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ফলে এই অবস্থার পরিবর্তন এসেঝে। বর্তমানে এই শ্রেণি দাস শ্রমিকের পর্যায় থেকে আধুনিক শ্রমিকের পর্যায়ে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্যে ‘নিরাপত্তা জাল’ কর্মসূচিসহ যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা এই আন্দোলনেরই ফসল।
এই প্রবন্ধে ইচ্ছা করেই কোন সূত্রবদ্ধ সেস্নাগান বা দাবিনামা বা উপসংহার উপহার দিচ্ছি না। তবে আমাদের আলোচনায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত আন্দোলনের জন্য পরিবর্তিত সম্ভাব্য সেস্নাগানগুলোর কিছু ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
৪. এমএম আকাশ, ‘গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক সংস্কারের আহ্বান’ (অপ্রকাশিত), নাগরিক কমিটির সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ভূমি সংস্কার বিষয়ে আলোচনা ও সাক্ষাৎকার উপলক্ষে রচিত অবস্থানপত্র।