গ্রামকে বদলে দিলেন নারীরা

ছুটির দিনের সকাল। এক বাড়ির উঠানে বসে বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন নারী ওড়নায় কারচুপির কাজ করছেন। সঙ্গে চলছে গল্প-হাসি-ঠাট্টা।

চিত্রটি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের বড়ালু গ্রামের এক বাড়ির। সেখানে যেমন আছেন ৩৮ বছর বয়সী জামিরুন নেসা, তেমনি আছে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ইমু আক্তার। আছে কিশোরী রোকসানা আক্তার ও তার মা জাহানারা বেগম। কেউ প্লাস্টিকের টুলে, কেউবা চেয়ারে বসে কুশিকাঁটা দিয়ে কারচুপির কাজ করছেন। কথা বলে জানা গেল, কেউ কাজ করছেন সংসারের খরচ জোগাতে, কেউবা নিজের পড়াশোনার খরচ মেটানোর পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগিতা করতে।

জামিরুন নেসার তিন মেয়ে, দুই ছেলে। তিনি বলেন, ‘আগে টুপি বানাইছি, আয় বেশি হওয়ায় আট মাস ধরে ওড়নায় কাজ করছি। সংসারে কষ্ট কমছে।’ ইমু বলল, ‘স্কুল বন্ধ থাকলে রোজ ১০টা ওড়নায় কারচুপির কাজ করতে পারি। আর স্কুল খোলা থাকলে ৬টা।’ এই আয়ের টাকায় ওর পড়াশোনার খরচ চলে, বাড়তি টাকা সংসারে খরচের জন্য মায়ের হাতে তুলে দেয়। ইমুর মা আমেনা বেগমও এই কাজ করেন। তিনি বলেন, স্বামী দিনমজুর, মেয়ে আর তিনি আয় না করলে সংসারে টানাটানি হতো। মেয়ের পড়াও হতো না।’

স্বামী তিনবার স্ট্রোক করে উপার্জনক্ষমতা হারানোর পর জাহানারা বেগম মেয়েকে নিয়ে ওড়না সেলাই করে সংসার চালাচ্ছেন।

সম্প্রতি বড়ালু গ্রামে গিয়ে দু-তিন বাড়ি পরপরই বিভিন্ন বয়সী নারীদের কুশিকাঁটায় কারচুপির কাজ করা চোখে পড়ে। কথা বলে জানা গেল, গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরের নারীরা এই কাজ করছে। এর মাধ্যমে তারা সংসারের অবস্থা বদলেছে। সেই সঙ্গে বদলে গেছে গ্রামের চিত্রও। বেড়েছে মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার হার।

গ্রামের বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ বললেন, কৃষিজমি কমে যাওয়ায় এবং গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় পুরুষদের কাজ কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ে সংসারে, পরিবারে। এই অবস্থা বদলাতে কুশিকাঁটা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন নারীরা। একটি ওড়নায় কারচুপির জন্য পাওয়া যায় ১০-১২ টাকা। তাঁদের কারও আয় মাসে দুই হাজার টাকা, কারও তিন হাজার, কারও আরও বেশি। কোনো কোনো পরিবারের দু-তিনজন বা চারজন ওড়নায় কারচুপির কাজ করছেন। এ আয় সংসারের প্রয়োজন মেটাচ্ছে, পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছে। গ্রামটিও পেয়েছে নতুন পরিচিতি, ‘ওড়না গ্রাম’। এ কথা শুনে মনে পড়ল, আসার পথে এক বাজারে বড়ালু গ্রাম কোনদিকে—প্রশ্ন করতেই কয়েকজন বলেছিলেন, ওড়না গ্রামে যাবেন।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামের মেয়েরা বহু আগে থেকে সেলাইয়ে পারদর্শী। তাদের কেউ কেউ শাড়ি বা ওড়নায় শখের বশে কাজ করত। কিন্তু পরে তা হয় উপার্জনের মাধ্যম। শুরুতে তারা মূলত টুপি ও শরীর পরিষ্কারের ছোবা তৈরি করত। কেউ কেউ সোয়েটারও বুনত। তবে ওড়নায় কারচুপির কাজে আয় বেশি হওয়ায় দুই বছর ধরে নারীরা এ কাজে ঝুঁকেছে। গ্রামের কয়েকজন নারী ঢাকার চকবাজার অথবা নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেট থেকে অর্ডার নিয়ে আসেন। প্রতি ওড়নায় কারচুপির জন্য তাঁরা চুক্তি করেন ৩০ টাকা। আর তাঁরা ওড়নাপ্রতি কাজটি করান ১০-১২ টাকায়। বাকিটা থাকে কাজ আনা নারীদের। তাঁদের একজন কুলসুম বেগম। তাঁর মাসে আয় ২০ হাজার টাকার বেশি।

সেলাই করতে করতে কয়েক নারী বললেন, এই কাজের সুবিধা হলো যেকোনো সময় করা যায়। সংসারের কাজের ফাঁকে, অবসরে, পড়ার ফাঁকে, রান্নার সময়, বিকেলে গল্প করতে করতে, রাতে অনায়াসে এই কাজ করা যায়। গৃহবধূ রেশমা আক্তার বলেন, ‘ঘরের কাজ শেষে ওড়না সেলাই করি। সময়ও কাটে, কাঁচাবাজারের পয়সাটাও মেলে।’

বয়স্ক নারীরাও নিজের খরচ চালাচ্ছেন হাতের কাজ করে। তাঁদের একজন ৬০ বছরের আসমা বেগম। একটি কালো রঙের ওড়নায় নকশা করতে করতে বললেন, তিন ছেলে থাকলেও কেউ তাঁর দেখভাল করেন না। তিনি ওড়নায় কারচুপি করে খেয়ে-পরে আছেন।

কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. গুলজার হোসেন বলেন, শুধু বড়ালু নয়, কায়েতপাড়ার মেয়েরাও হাতের কাজ ভালো জানেন। সেলাই করে তাঁরা স্বাবলম্বী। এতে তাঁদের সংসারের আর্থিক অবস্থা ভালো হচ্ছে, মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার হারও আগের তুলনায় বেড়েছে।

নারীরা আয় করায় আর্থসামাজিক অবস্থায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামজুড়ে। মাটির ঘরের জায়গায় উঠছে টিনের ঘর আর টিনের ঘরের জায়গায় পাকা ঘর। বিকেলের নাশতা এখন নিয়মিত। সংগতি আসায় কেউ কেউ মাটির চুলা ছেড়ে গ্যাসে রান্না করছেন। এমন একজন কাকলি আক্তার বলেন, গ্যাসের চুলায় রান্না করলে কষ্ট কম, সময়ও বাঁচে।

অবশ্য নারীদের এই উপার্জন শুরুতে বাড়ির পুরুষেরা ভালোভাবে দেখতেন না। কিন্তু যখন দেখলেন, পরিবারে সচ্ছলতা আসছে, ঘরে বসেই করা যায়—তখন আর আপত্তি করেননি, বরং খুশি হয়েছেন। কারচুপির কাজ করেন এমন কয়েকজন নারীর স্বামী বললেন, তাঁদের সংসার চালানোর চাপ কমে গেছে। সংসারে আয় বেড়েছে। এসেছে বাড়তি সচ্ছলতা।

গ্রামের মুদিদোকানি আমানুল্লাহ ব্যাপারী বলেন, ‘আমার দুই মাইয়া আর স্ত্রী ওড়না সেলাই করে। সেই টাকা জমাইয়া মাটির ঘর ভাইঙ্গা টিনের ঘর তুলছি।’ জামদানি শাড়ি তৈরি করেন ইয়াসিন মিয়া। তাঁর স্ত্রী করেন ওড়নায় কারচুপির কাজ। ইয়াসিন বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আয় করলে সংসারে অভাব কমে, ঘরে সুখ আসে।’