পেটে ক্ষুধা নিয়ে জগতের কোনো কিছুই ভালো লাগে না। আকাশের চাঁদকে রুটি বলে ভ্রম হয়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাই বলেছেন ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। অতি দরিদ্র পরিবারের বা ছিন্নমূল শিশুরা শিক্ষাবঞ্চিত থাকার পেছনের গল্প অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই-ই। এবার এই গল্প পাল্টাতে অভিনব পদ্ধতিতে কাজ করছে রংপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও বয়স্কদের মাত্র এক টাকায় একবেলা খাবার খাইয়ে শিক্ষাদান করছে। ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি রংপুর নগরীর সুবিধাবঞ্চিত ও ঝরেপড়া একশ’রও বেশি শিশু ও বয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন দুপুরে মাত্র এক টাকায় সুস্বাদু এই খাবার বিতরণ করছে। পারিবারিকভাবে সামর্থ্যহীন, অক্ষরজ্ঞানহীন এসব শিশুকে মাটিতে মাদুর পেতে বসিয়ে হাতেকলমে পাঠদানের ব্যবস্থা আছে। এতে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদান করছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া এই শিশুদের হাত-পায়ের নক, চুল কাটানো,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান-শ্যাম্পুও দেওয়া হয়। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, আনন্দের মাঝে শিক্ষা দেওয়াই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য। ‘পড়ব, খেলব, শিখব’-বিষয়কে সামনে রেখে রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়া, রেল স্টেশন, পার্কের মোড় ও মডার্ন মোড়ে প্রতিদিন একশ’রও বেশি সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুকে ১ টাকার বিনিময়ে খাবার দেওয়া হয়। এই এক টাকার খাবার ১২ বছরের নিচে শিশু ও ৬০ বছরের ঊর্ধ্বের বয়স্কদের বিতরণ করা হয়। এই কাজে প্রতিদিন রংপুর শাখায় ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। এসব স্বেচ্ছাসেবক নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। প্রতিদিন ১২০ জন শিশু ও বৃদ্ধের জন্য এই খাবারগুলো রান্না হয় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের আলম নগর কার্যালয়ে। প্রতি শুক্রবার পোলাও-ডিম, শনিবার সাদা ভাত, আলু ভর্তা ও ডাল, রোববার ভাত-মুরগির মাংস, সোমবার খিচুড়ি ডিম, মঙ্গলবার পোলাও-চাইনিজ সবজি, বুধবার ভাত-ডাল ভাজি, বৃহস্পতিবার সবজি খিচুড়ি দেওয়া হয়। এই রান্নাও করেন ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক নগরীর কেরানীপাড়ার বাসিন্দা ও কাউনিয়া কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র হূদয় ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র রিমন। তাদের সহযোগিতা করে অন্য স্বেচ্ছাসেবকরা। গত সোমবার ৩টার দিকে রংপুর রেল স্টেশনের প্লাটফর্মের সামনের ফাঁকা জায়গায় ৩২ জন শিশুকে পাঠদান করাচ্ছিলেন কারমাইকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মারজান সাদিক সাদ ও রাহি। লেখাপড়া শেষে তাদের খিচুড়ি ও ডিমের বক্স দেওয়া হয়। এ সময় আরও ১২ জন বয়স্ক মানুষকে খাবার বক্স দেওয়া হয়। লেখাপড়া ও খাবার শেষে ওই কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক মারজান সাদিক সাদ জানান, সময় করে এই কেন্দ্রে এসে প্রতিদিন তিনি ৩০-৩৪ জন সুবিধাবঞ্চিত ঝরেপড়া শিশুকে লেখাপড়া করান। এই শিশুরা দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। ‘খাবারের দাম এক টাকা কেন?’-জানতে চাওয়া হয়েছিল বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবী সমন্বয়কারী ও কারমাইকেল কলেজের অ্যাকাউন্টিং চতুর্থ বর্ষের ছাত্র রায়হানকে। তিনি বলেন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা যেন খাবারটাকে ভিক্ষা না ভাবে এজন্যই খাবারের মূল্য নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রায় ২০ জন প্রতিদিন পালাক্রমে এসব কাজ করে থাকি। ৪টি স্থান ছাড়াও কেন্দ্রে আরও ৪৫ জনকে শিক্ষা ও ১৫ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। তিনি জানান, রংপুরে সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুর জন্য গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে নামমাত্র মূল্যে ব্যতিক্রমী এ কার্যক্রম চালাচ্ছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। যার উদ্যোক্তা পেরু প্রবাসী এক বাংলাদেশি। বিদ্যানন্দের এই এক টাকায় আহার কর্মসূচির খরচসহ লেখাপড়ার খরচের প্রায় পুরোটাই জোগান দেন তিনি। পাশাপাশি রয়েছে বাইরের কিছু সহায়তা। প্রবাসী এই বাংলাদেশি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার নাম কিশোর কুমার দাশ। তিনি নিজেও সুবিধাবঞ্চিত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে চাকরির সুবাদে বর্তমানে আছেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। অতীতকে স্মরণ করেই তিনি দাঁড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্ষুধার্ত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে।