একটা সময় জুমচাষ দিয়েই সহজে নির্বাহ করা যেত সংসার। আজ পাহাড়ি পরিবারে মানুষ বেড়েছে, কমেছে জুম আবাদের জমি। সে কারণেই একই স্থানে ঘন ঘন করতে হচ্ছে জুমচাষ। ফলে মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে, হচ্ছে মাটির ক্ষয়ও। জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ এখন তাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জমি প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে ফসল তুলতে মোট সময় লাগে সাত-আট মাস। বছরের চারটি মাস ধরে সে জমি থেকে যায় পতিত। আর এ সময় কোনো ফসল জমিতে না থাকায় জমি থেকে যায় অনাবাদি সে জন্য আধুনিক চাষাবাদে ঝুঁকছেন পাহাড়ি জুম চাষিরা…
ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া
জুমের পাহাড় থেকে ধান সংগ্রহ করছেন এক উপজাতি তরুণী ছবি : ইন্টারনেটবাংলাদেশের তিন পাহাড়ি জেলায় বাস করে ১৫ রকমের উপজাতি। একটা সময় এসব পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা ছিল জুমচাষ। পাহাড়ের একটি নির্দিষ্ট স্থান পুড়ে নিয়ে তা আগাছা মুক্ত করে পোড়া ছাই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে প্রস্তুত করা হতো জমি। অতঃপর ধানসহ নানারকম ফসলের বীজ একত্রে মিশিয়ে নিয়ে জমিতে গর্ত করে দু-চারটি বীজ একেকটি করে গর্তে পুঁতে দিয়ে শুরু হতো জুমচাষ। অতঃপর চলত নানারকম পরিচর্যা আর সময়ভেদে একেকটি ফসল সংগ্রহের কাজ। আজও অনেক উপজাতি এ পেশাকে অবলম্বন করে আছেন। কোনো কোনো উপজাতি এর পাশাপাশি অন্য পেশাও আজ গ্রহণ করছেন।
একটা সময় জুমচাষ দিয়েই সহজে নির্বাহ করা যেত সংসার। আজ পাহাড়ি পরিবারে মানুষ বেড়েছে, কমেছে জুম আবাদের জমি। সে কারণেই একই স্থানে ঘন ঘন করতে হচ্ছে জুমচাষ। মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে, হচ্ছে মাটির ক্ষয়ও। ফলে ফলন যাচ্ছে কমে। জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ এখন তাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তা ছাড়া সঠিকভাবে বললে সারা দেশেরই মানুষ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বেড়েছে সবরকম খাদ্যের চাহিদা। অথচ পাহাড়ের জমি রয়েছে এখনো অনেকটাই অপরিকল্পিত চাষের আওতায়। কৃষি উন্নয়ন ভাবনায় তাই পাহাড় অগ্রাধিকার পাবে সেটিই স্বাভাবিক। জুমচাষ হয় বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে। জমি প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে শেষে ফসল তুলতে মোট সময় লাগে সাত-আট মাস। বছরের চারটি মাস ধরে সে জমি থেকে যায় পতিত। আর এ সময় কোনো ফসল জমিতে না থাকায় জমি থেকে যায় অনাবাদী। তা ছাড়া জুমে আবাদ করা প্রতিটি ফসলের উৎপাদন বিবেচনায় নিলে হতাশ না হয়ে পারা যায় না।
কৃষিজমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এখন সময়ের দাবি। এমনকি টেকসই পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতি বর্গ একক জমি থেকে কতটা উৎপাদন নিশ্চিত করা যায় সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে কারণেই সরকার গুরুত্ব দিয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলের জমির সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনায়। এগিয়ে এসেছে বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সম্প্র্রসারণ বিভাগসহ নানারকম সরকারি-বেসরকারি উদ্যেক্তারা। বহু প্রকল্পের অধীনে চলছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সমন্বিত কৃষি কার্যক্রম পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করতে। বিশেষ করে ফল ফসল ও মসলা চাষের জন্য এসব কর্মকা-ের স্বাক্ষর পাহাড়ের পথে পথে ইদানীং বেশ চোখে পড়ছে।
কলা পাহাড়িদের এক প্রিয় ফল। এখানকার পাহাড়ের ভেতরে চোখ রাখলে সহজেই চোখে পড়ে নানারকম বুনো কলাগাছের উপস্থিতি। অঙ্গজ বংশবৃদ্ধি করতে পারে বলে এরা সহজেই বংশবিস্তার করে নেয়। বুঝি সে কারণেই বুনো কলার প্রাচুর্য সহজেই লক্ষণীয় পাহাড়ে পাহাড়ে। এই প্রাচুর্যতা দেখে মনে হয় যেন কলা উৎপত্তির একটি কেন্দ্র বা নিদেন পক্ষে একটি উপকেন্দ্র এই পাহাড়ি অঞ্চল। সে যাই হোক এখানে কলাগাছ রুয়ে দেয়ার প্রচলন বেশ প্রাচীনকাল থেকে। জুম মাঠে তাকালে দু-চার-দশটি কলাগাছ চোখে পড়বেই। এখন কিন্তু পরিকল্পিতভাবে লাগানো হচ্ছে কলাগাছ। চম্পা কলা ও বাংলা কলার গাছই এখানে সিংহভাগ। দুই ঋতুতে এখানে এখন প্রচুর কলা সংগ্রহ করা যায়। বর্ষায় আর শীতে এখানকার পথে-ঘাটে সর্বত্রই কলার ছড়ি জমা করতে দেখা যায়।
পাহাড়ে আগে ঘর-বাড়ির আশপাশে বনে-জঙ্গলে কেবল আমগাছ দেখা যেত। ‘রাঙু’ নামের সেই আম ছিল বান্দরবান এলাকার অতি জনপ্রিয় আম জাত। বুকের দিকটায় এক ফালি স্থান দেবে যাওয়া বৈশিষ্ট্যম-িত এই আমারে বর্ণ বেশ লাল আর এর একটি বিশেষ রকম আমুদে গন্ধ রয়েছে। খেতে মন্দ নয়, আম জাতটি। এখন তো সারিবদ্ধভাবে পাহাড়ে লাগানো হয়েছে নানা জাতের আমগাছ। এদের চমৎকার বৃদ্ধিও ঘটছে। পাহাড়ের অনাবাদী অংশও তাতে সবুজে ঢাকা পড়ছে। এসব আমগাছে ফল ধরতে শুরু করলে নিঃসন্দেহে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদার প্রাপ্যতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। এমনকি এসব ফল দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পেঁপে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আরেকটি প্রিয় ফল। ডিসেম্বরের শেষদিকে পাহাড়ি পথের ফল সংগ্রহের জন্য নির্মিত ঘরগুলোয় আর আঙিনায় পেঁপের বিশাল স্তূপ চোখে পড়ে। পাহাড়িরা এসব পেঁপে কেটে এনে জমা করছে সেখানে। এখান থেকে তা চালান হয়ে যাবে শহরে এবং দূর-দূরান্তে। পেঁপেগুলো নানা আকৃতির বটে তবে ঢাউস আকৃতির পেঁপের সংখ্যা কম নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এগুলো অধিকাংশই হাইব্রিড জাতের পেঁপে। লাগানো হচ্ছে লাইন করে স্থানে স্থানে। এসব ফল চাষে বেড়েছে পাহাড়িদের সম্পৃক্ততা। কাঁচা পয়সা অর্জনের একটি বড় সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে তাদের। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগও তাতে সৃষ্টি হয়েছে।
আনারসের জন্য পাহাড় এক বিখ্যাত স্থান সেই প্রাচীনকাল থেকেই। একটু ছায়াময় স্থানে এই ফলটির নির্বিঘ্নে আবাদ করা যায় বলেই হয়তো নানারকম গাছগাছালির নিচে আনারসের অঙ্গজ অংশ পুঁতে দিয়ে জন্মানো হয় এখানে আনারস। ভারী দৃষ্টিনন্দনভাবে লাগানো হয় আনারসের চারা। জমি পরিষ্কার করে পাশাপাশি দুই লাইন করে লাগিয়ে যাওয়া হয় চারা, প্রতি দুই লাইন পর পর একটুখানি বেশি করে ফাঁক রাখা হয় এদের পরিচর্যা নিশ্চিত করার জন্য। আনারস চাষ এবং এদের যত্ন নেয়ার প্রতিও পাহাড়িদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। অনেক নতুন নতুন আনারস বাগান চোখে পড়েছে পাহাড়ে।
লিচুর বাগানও গড়ে তোলা হয়েছে অনেক স্থানেই। ভারী চমৎকার দেখতে এসব বাগান। হয়তো লিচু ধরতেও শুরু করেছে। দেখলাম বরই গাছের বাগানও কোথাও কোথাও। জাত বাছাই করে এসব বরই চারা সরবরাহ করা হয়েছে। পাহাড়ে কমলারও অল্প কিছু গাছ দেখলাম যেতে যেতে। দেখলাম কাঁঠাল, সুপারি আর নারকেলের গাছ। সবচেয়ে অবাক লেগেছে রাগুনিয়া থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথে শজিনাগাছের সারি দেখে। শজিনাগাছের ডাল কেটে কেটে পুঁতে দেয়া হয়েছে পথের পাশে। এটি একটি অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ সন্দেহ নেই। সহজে বংশবৃদ্ধি করা যায়। সবজি হিসেবে শজিনা পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। ফল পেতে কষ্ট কম।
শীতকালে চিম্বুক পাহাড়ের নিচের অস্থায়ী ফলের দোকানে চোখে পড়ল একটি চমৎকার আকৃতির কাঁঠাল। এরকম অসময়ের কাঁঠাল দেখে আমার মধ্যে বড় আশাবাদ জেগে উঠল। উদ্যানতত্ত্ববিদরা এরকম কাঁঠালের হাজার হাজার চারা করে নিতে পারেন এসব গাছের কাঁঠাল সংগ্রহ করে নিয়ে। মৌসুমে কাঁঠাল এখানে বড় সস্তা। তখন কাঁঠালের প্রতি আমাদের অবহেলারও শেষ থাকে না। শীতকালে আমাদের দেশি ফলের ঘাটতিও রয়েছে। এসময় কাঁঠাল ধরলে এর আকর্ষণও বাড়বে আর এই সময়ের ফলের ঘাটতিও পূরণ করা যেতে পারে।
জাম্বুরাও চোখে পড়ছে বান্দরবানে বেশ। দুই রকমের জাম্বুরা দেখলাম। একটির ফল খাড়া প্রকৃতির। সমতলে এটি কম দেখা যায়। ভেতরটা বেশ লাল এবং স্বাদও বেশ। অন্যটি আমাদের সমতল এলাকার মতোই ওপরে নিচে চ্যাপ্টা গোলাকার জাম্বুরা। কোনোটার ভেতরের কোয়া লাল তো কোনোটার আবার লালচে পেঁয়াজ বর্ণ। জাম্বুরার আবাদও বাড়ানো যায় পাহাড়ে। পাহাড়ে এখন আবাদ করা হচ্ছে সমতলের আমড়াও। বেশ ভালো এদের ফলন সেখানে। আমড়ার আবাদ এলাকা বিস্তৃতির সুযোগ পাহাড়ে রয়েছে। লেবু তো পাহাড়ে চাষ করা হচ্ছে সেই কবে থেকেই। এখানকার লেবুর বৈচিত্র্যও অনেক। এদের স্বাদের ভিন্নতাও বেশি। পাহাড়ের কোনো কোনো লেবুজাত বীজহীন বলে এরা ভোক্তাদের কাছে অনেক লোভনীয়। এদের অঙ্গজ চারার সংখ্যা বৃদ্ধি করে পাহাড়ে সমতলে দুই জায়গায়ই বৃদ্ধি করা যায় বীজহীন লেবুর আবাদ।
যেতে যেতে পাহাড়ি সমতটে চোখ পড়ল বিদেশি এক ফল ফসলের ওপর। পাহাড়ি এক ফলচাষি এক চিলতে জমিতে যত্ন করে রোপণ করেছে ড্রাগন ফলের চারা। বেশ অবাক হই তাদের সচেতনতার প্রমাণ দেখে। তা ছাড়া ফল ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করারও এটি একটি স্বাক্ষর।
পাহাড়ে শাক-সবিজ আবাদও বৃদ্ধি পেয়েছে আগের তুলনায়। বেড়েছে শাক-সবজির বৈচিত্র্যও। এমনকি শীতকালে যেখানেই পানির উৎস রয়েছে সেখানেই চোখে পড়েছে নানারকম শীতকালীন সবজি ফসল। কমলার জন্যও বেশ প্রসিদ্ধ লাভ করেছে কোনো কোনো পাহাড়ি অঞ্চল। মরিচ তো এখানকার জুমচাষের এক অনিবার্য অনুসরণ। তা ছাড়া একক মরিচ আবাদ দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আদা আর হলুদের বাগান এখানে প্রায়ই চোখে পড়েছে। এর মানে এদের আবাদও বাড়ছে দিন দিন।
পাহাড়ের কৃষির আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো_ ফল বা সবজিচাষ ব্যবস্থাপনার তাৎপর্যময় উন্নতি। সাজানো-গোছানো ফলের বাগান পাহাড়ি মানুষের আগাছা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ফসল ব্যবস্থাপনার দিকে বাড়তি মনোযোগেরই সাক্ষ্য বহন করছে। পাহাড়ি মানুষ পরিশ্রমী। ফলে কোনো প্রযুক্তি তারা গ্রহণ করলে তা বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই গ্রহণ করে। তা ছাড়া প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাদের আগ্রহ এখন অনেকটাই বেড়েছে। নানারকম প্রকল্পভিত্তিক প্রশিক্ষণও হাতে-কলমে শিক্ষা স্পষ্টতই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে শাক-সবজি আর ফলমূলের চাষ আরও বৃদ্ধি করা গেলে তা পাহাড়ি ও সমতল উভয় জনগোষ্ঠীর জন্য এক তাৎপর্যময় বিষয় হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : অধ্যাপক, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা