মেঘনার চরাঞ্চলে হাঁসের খামার

মেঘনা মোহনায় জেগে ওঠা অর্ধশতাধিক চরে রীতিমতো হাঁসের বিপ্লব ঘটেছে। চরের চারপাশের পানিতে এখন ভেসে বেড়ায় অসংখ্য হাঁস। মেঘনার ঢেউয়ে তাল মিলিয়ে হেলেদুলে ভেসে বেড়ানো হাঁসের এ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতে হয় সবাইকে। অনুকূল পরিবেশ আর খাবারের সহজলভ্যতার কারণে চরের লোকজন হাঁস পালন করে এখন অধিক লাভবান হচ্ছেন।
জানা গেছে, ভৈরব থেকে সিলেট মোহনার অভিমুখী ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছোট-বড় অর্ধশতাধিক চর রয়েছে। যার অধিকাংশেই বর্তমানে বসতি গড়ে উঠেছে। মাছ শিকারকে কেন্দ্র করে বসতি গড়ে উঠলেও মাছ শিকার আর হাঁস পালন এখানকার বাসিন্দাদের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে চরের যুব সম্প্রদায় তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নদীতে জাল ফেলার চেয়ে এখন হাঁস পালন করতে বেশি আগ্রহী। অনুকূল পরিবেশ থাকায় কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর উপজেলার কয়েক খামারি এ মৌসুমে ভৈরব, আশুগঞ্জ, মেঘনা নদীর মাঝে সোনারামপুর চরে অস্থায়ীভাবে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার।
আশুগঞ্জের সোনারামপুর চরে রয়েছে হাঁসের ১০-১২টি খামার। ওই চরে অষ্টগ্রাম উপজেলার আবদুল্লাহপুরের অস্থায়ী হাঁসের খামার মালিক আক্তার হোসেন। তিনি জানান, বর্তমানে তার ১ হাজার ১০০ হাঁস রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ হাঁস ডিম দেয়। ভোরে খামারের তলদেশে ডিমের সাদা বর্ণ ধারণ করে। এই দৃশ্য দেখে কারো মন খারাপ হওয়ার জো নেই। এ এক অন্য রকম সৌন্দর্য- ভিন্ন রকম আনন্দ। একই চরের কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলীর উপজেলার সালেক মিয়ার হাঁস খামারে রয়েছে ১ হাজার ৮০০ হাঁস, প্রতিদিন ডিম দেয় ১ হাজার ১০০। তা ছাড়া কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার আবদুল্লাহপুর গ্রামে আবদুস সাদেকের রয়েছে ২ হাজার ২০০ হাঁস, প্রতিদিন ডিম দেয় ১ হাজার ১০০। চরের খামারিরা জানান, প্রতিদিন সকালে এসব ডিম নৌকাযোগে ভৈরব, আশুগঞ্জ বাজারসহ পার্শ্ববর্তী বাজারগুলোতে বিক্রি করা হয়। আবার পাইকাররাও চরে আসেন ডিম কেনার জন্য।
সাদেক মিয়া জানান, প্রতিদিন তার ডিম বিক্রি করে আয় হয় ৩ হাজার টাকা। আর ১ বছর পর হাঁসগুলো বিক্রি করে পাওয়া যায় মোটা অংকের টাকা, প্রতিটি হাঁস গড়ে বিক্রি হয় ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়। খাবার হিসেবে সব সময় গম, ধান, শামুক দিতে হয়। এ জন্য চরে এবং চরের বাইরে গড়ে উঠেছে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। একশ্রেণির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকাবোঝাই করে শামুক সংগ্রহ করে নির্ধারিত মূল্যে এসব খামারে সরবরাহ করেন।
আবদুল্লাহপুরের আক্তার হোসেন জানান, মাঝেমধ্যে তারা হাঁসের খাবার নিয়ে সংকটে পড়েন। খাবার সংগ্রহে কোনো সমস্যা দেখা দিলে এতে হাঁসের খাবারের জোগান দেয়া তাদের পক্ষে খুবই কষ্ট হয়ে পড়ে। এসব এলাকায় পশু ডাক্তার না থাকায় পরামর্শের জন্য তাদের বড়ই সমস্যা পড়তে হয়। তিনি আরো বলেন, ডিম বিক্রি নিয়ে সমস্যা পড়তে হয়। সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের কারণে ডিমের বাজার পড়ে যায়। অনেকেই পুঁজির সমস্যার কথাও বলেন। ব্যাংক থেকে তাদের পক্ষে ঋণ পাওয়া খুবই দুষ্কর হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা সমাধান করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহাজনদের ঋণ পরিশোধ করে লাভের মুখ দেখা যায় না। উঠতি বয়সের তরুণরা জানান, তাদের মনে অনেক আশা হাঁস পালনে এগিয়ে আসার ব্যাপারে। শুধু পুঁজির অভাবে সম্ভব হয়ে উঠছে না। সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা গেলে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে হাঁস পালনে আরো বড় ধরনের বিপ্লব ঘটে যেতে পারে।
কেন তাদের এলাকা ছেড়ে চর সোনারামপুর চরে অস্থায়ী হাঁসের খামার করার বিষয়ে জানতে চাইলে খামারিরা বলেন, আমাদের এ সময় শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় এবং নি¤œ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বোরো ধানের আবাদ করা হয়, বিধায় আমরা ওই সময় এলাকাতে হাঁসের খামার করতে পারি না। এর কারণে খামার থেকে সকাল বেলা হাঁস ছাড়লে ধান ক্ষেতে ঢুকে ধান খেয়ে ফেলাসহ জমির ফসল নষ্ট করে ফেলে। তাই ভৈরব ও আশুগঞ্জের মেঘনা নদীর মাঝখানে চর সোনারামপুর চরে আমরা অস্থায়ীভাবে ৩ মাসের জন্য হাঁসের খামার গড়ে তুলি। বর্ষাকাল এলে আমরা আবার আমাদের এলাকায় চলে যাই। তারা আরো জানান, অনুকূল পরিবেশ আর খাবারের সহজলভ্যতার কারণে আমরা ওই চরে হাঁসের খামার করতে আগ্রহী হই এবং হাঁসের খামার থেকে ডিম বিক্রি করে এখন অর্থনৈতিকভাবে অধিক লাভবান হচ্ছি।