১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে শুধু মাতৃক্রোড়েই জন্মগ্রহণ করে না। বরং একটি দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি সর্বোপরি একটি জাতির কোলেও জন্মগ্রহণ করে। এ জন্য শুধু মা-বাবা কিংবা বংশের পরিচয়ই ওই শিশুর সব পরিচয় নয় এবং দেশ, সমাজ ও জাতিগত পরিচয়ই তার বৃহত্তর পরিচয়। আমাদের দেশ ও সমাজে ১৯২০ সালের এই দিনে এমনই একজন শিশু জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি জাতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আপন যোগ্যতায় হয়ে উঠেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর জাতিগত পরিচয়, জীবন, কর্মপরিধি এবং দেশাত্মবোধ এতই গভীরে প্রোথিত যে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা সত্যিই দুরূহ কাজ। তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি। এ জন্য আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিস্মরণীয় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা। স্বাধীনতা-পূর্বকালে আমাদের জাতি ছিল অপশাসিত, শোষিত ও বঞ্চিত। বঙ্গবন্ধু প্রকৃত অর্থেই জাতিকে এ অপশাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে একটি সত্যিকার সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু মানেই সোনার বাংলা এবং বঙ্গবন্ধু মানেই স্বপ্নের বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু সর্বতোভাবেই এ দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। কী করে দেশের কল্যাণ হবে, কী করে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অবসান হবে—এটাই ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক চিন্তা। শুধু চিন্তা করলেই যে চলবে না, সে জন্য আন্তরিকভাবে কাজও করতে হবে—এ উপলব্ধি থেকে ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর আপসহীন সংগ্রাম ও অপরিসীম দেশাত্মবোধের জন্যই ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতিসত্তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। বাঙালি জাতির দুঃখ-বেদনা, হতাশা-বঞ্চনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গরূপে তাঁর কণ্ঠেই বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হয়। তিনিই বঙ্গবন্ধু, যিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে’। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও যিনি জাতিসত্তার এমন অহংদীপ্ত উচ্চারণ করতে পারেন, তিনি প্রকৃত অর্থেই ‘বঙ্গবন্ধু’। বস্তুত বঙ্গবন্ধুই ছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশের প্রথম প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে একজন মহামানবের আবির্ভাব কামনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেই ব্যক্তি, যিনি মহামানবের সংজ্ঞা ধারণ করেই জাতির মাহেন্দ্রক্ষণে নদীমেখলা এ বাংলার মাটি স্পর্শ করেছিলেন। যে মাটি ছিল অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত এবং যে মাটির মানুষ ছিল শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত। বঙ্গবন্ধু বাঙালির দুঃখ-কষ্টকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। বাঙালি জাতিকে শোষণমুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। যে ডাক বঙ্গবন্ধুর মতো করে আর কেউ দিতে পারেননি; এমনকি জাতীয় চেতনায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধও করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর এ উদাত্ত আহ্বানের লক্ষ্য ছিল একটিই, আর তা হলো একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গঠন। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আসলে বাংলাদেশেরই জন্ম হতো না। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাই চাননি, এ দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তিও চেয়েছেন, একটি সমৃদ্ধিশীল স্বনির্ভর বাংলাদেশও কামনা করেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশ গঠনে তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তিনি সামগ্রিকভাবে প্রশাসনকে পুনর্গঠিত করে প্রশাসনযন্ত্রকে জনসেবায় নিবেদিত হওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দেশ ও জাতির স্বার্থে জনগণের মালিকানা ও অংশীদারি নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের ভারী শিল্প, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদিকে জাতীয়করণ করেন। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে শিক্ষিত জনগণ ছাড়া জাতীয় উন্নতি সম্ভব নয়। সে জন্য তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি চালু করার পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকারীকরণও করেছিলেন। দেশের জন্য সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু একটি আধুনিক ও শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গঠনের সব পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সব কর্মসূচির মূলে একটি সত্যই প্রতিভাত ছিল, আর তা হচ্ছে আত্মনির্ভরশীল একটি জাতি তথা সর্বক্ষেত্রে স্বনির্ভর বাংলাদেশ।
আমাদের দেশ শিল্পে ততটা উন্নত নয়। ‘কৃষিই জাতির মেরুদণ্ড’—এজাতীয় উক্তি এখনো আমাদের দেশে প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি উপলব্ধি করে আমাদের কৃষিব্যবস্থায় গতি সঞ্চার করেন। সব কৃষক যাতে জমি পায় সে জন্য বঙ্গবন্ধু ভূমি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তিনি কৃষিতে ভর্তুকি প্রথা চালু করেছিলেন।
একটি স্বাধীন, সার্বভৌম আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বস্তরের মানুষকে সমন্বিত করে বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এ চারটি মূল নীতিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন মত, পথ ও নির্দেশনায় দ্বিধাবিভক্ত জাতি বঙ্গবন্ধু কখনো প্রত্যাশা করেননি। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালি জাতিসত্তার অভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী সবাইকে নিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে। এ জন্য বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দগুলো পৃথক সত্তায় বিরাজ করে না। বরং এসবই একই মোহনায় বিরাজিত অভিন্নার্থক শব্দবন্ধ। বঙ্গবন্ধু সেই গণতন্ত্র চেয়েছিলেন, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। সেই প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্যই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত একটি সমাজব্যবস্থার স্বপ্নে বিভোর হয়েই সব সময় আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বঙ্গবন্ধু আইন করে কোনো ধর্মকেই বন্ধ করতে চাননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন একটি ধর্মীয় সম্প্রীতি। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ধর্ম পালন করবে এবং এ নিয়ে কারো সঙ্গে কারোরই কোনো বিভেদ বা হানাহানি থাকবে না, এই ছিল মূল কথা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য তাঁর প্রদর্শিত পথ ও আদর্শ আজও আমাদের কাছে আলোকবর্তিকাস্বরূপ। সেই আলোকবর্তিকা অনির্বাণ। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের কিংবদন্তির মহানায়ক। এ মহানায়কের মহামন্ত্রেই একদিন গড়ে উঠবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। যত দিন বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন বঙ্গবন্ধুও থাকবেন।
লেখক : অধ্যক্ষ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ