একটা সময় ছিল বাংলাদেশে পাটের জয়জয়কার অবস্থা ছিল। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে পাটের বাজার আস্তে আস্তে কমতে থাকে। আর কমতে কমতে এক সময় এমন অবস্থার মধ্যে এসে ঠেকেছিল যে, শুধু গরু বাঁধার দড়ি কিংবা পাটখড়ি ব্যবহারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামান্য কিছু পাট আবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের তৎপরতায় সেই পাটের সুদিন আবার ফিরতে শুরু করেছে।
পাটের কথা বলতে গেলে সেই ছোটবেলার কিছু স্মৃতিময় কথা না বললেই নয়। ছোটবেলায় মুরব্বিদের কাছে শুনতাম, বাজারে তাঁতের সুতোয় বুনা শাড়ি-লঙ্গির পাশাপাশি পাটের তৈরি শাড়ি-লুঙ্গি পাওয়া যেত। সে সময় এগুলো ছাড়া নাকি কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান পর্যন্ত হতো না। কিন্তু পাটের তৈরি সে জিনিসগুলো দেখতে সুন্দর হলেও দামে তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা ছিল। তবে বিভিন্ন মাত্রায় সিল্ক-পাট কিংবা সুতা-পাটের মিশ্রণেও অনেক সুন্দর সুন্দর শাড়ি-লুঙ্গিসহ কাপড়-চোপড় পাওয়া যেত, যা সত্যিই দেখার মতো ছিল।
সারা দেশের কৃষিব্যবস্থা ছিল পাটময়। মৌসুমে যেদিকেই যাওয়া যেত সারি সারি পাটক্ষেত দেখলে মন জুড়িয়ে যেত। পাটক্ষেত বড় হয়ে পরিপক্ব হলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ উচ্চতায় পুরো মাঠ আবৃত হয়ে থাকত। রাস্তার দুধারে পাটের ক্ষেতের জন্য আশপাশের কোনো কিছু দেখতে পাওয়া যেত না। তা ছাড়া পাট কাটা এবং জাগ দেওয়ার সময় এলে চারদিকে পাট পচার গন্ধ এখনো নাকে যেন আটকে আছে। চারদিকে গ্রাম-গ্রামান্তরে পাট পচানো, পাট থেকে আঁশ ছাড়ানো, আঁশ ছাড়ানোর পর সারি সারি পাটশোলা শুকানোর ধুমÑ ইত্যাদি কার্যক্রম এখন আর চোখে পড়ে না।
সে সময় পাট ছিল বাংলাদেশের একমাত্র রপ্তানি পণ্য। তা ছাড়া দেশে বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত পাটের প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রায় ৮৭টি পাটকল ছিল। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সেসব পাটকল জাতীয় স্বার্থে জাতীয়করণ করে দিয়েছিলেন। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারায়ণগঞ্জের আদমজী এবং সিরাজগঞ্জের কওমি পাটকল ছিল। কারণ নারায়ণগঞ্জ ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদীবন্দর, যাকে প্রাচ্যের ডা-ি বলা হতো। অপরদিকে বাংলাদেশের সব জেলায়ই কম-বেশি পাট উৎপাদন হলেও ময়মনসিংহ, রংপুর, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় প্রচুর পরিমাণে পাট ফসল উৎপাদিত হতো। সে সময়ে পাট ব্যবসায়ীদের অনেক কদর ও নামডাক ছিল। বাজারে বাজারে ঘাটে ঘাটে পাটের হাটবাজার, মহাল, আড়ত, গুদাম ইত্যাদিতে ভরপুর ছিল। পাট মৌসুমে কাঁচা পাটের গন্ধে প্রকৃতিতে এক অন্যরকম পরিবেশ বিরাজিত ছিল। সে সময় হাটবাজার করার জন্য পাটের ব্যাগ ছিল ঐতিহ্য। প্রত্যেকের বাড়ির কর্তা হাটবাজার করার জন্য সেই পাটের ব্যাগ নিয়ে বের হতেন। একটি পাটের তৈরি ব্যাগ দীর্ঘদিন যাবৎ সেই পরিবারের বাজার-সওদা করার কাজে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। আর এই দিন পাল্টানো পাটের জন্য খারাপ সময় ডেকে এনেছে। একদিকে দিনে দিনে বিশ্ববাজারে পাটের বিকল্প তন্তু আবিষ্কৃত হয়েছে, অপরদিকে সেসব কৃত্রিম তন্তু দামে পাটের তুলনায় অনেক সস্তা হওয়ায় অনায়াসে সেগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে জন্য কমতে থাকে পাটের গুরুত্ব ও দাম। অপরদিকে আমরা জানি, পাট ভেজানো ও পচানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন পড়ে। সঙ্গত কারণেই পাটের আবাদ করতে কৃষকরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে থাকে। সেই সুযোগে কৃষিপরিক্রমায় ফসল চক্রে পাটের স্থান দখল করে নেয় অন্যান্য ফসল।
আমরা আরও জানি, বঙ্গবন্ধু সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে পাটের গুরুত্ব বিচেনায় পাটকলগুলোকে জাতীয়করণ করে পাটের বহুমুখী ব্যবহারের ওপর সবিশেষ অগ্রগতি অর্জনে ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকারের আমলে আস্তে আস্তে সেসব পাটকল প্রথমে বেসরকারিকরণ ও পরে বন্ধ করে দিতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকল, ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ পাটকলসহ অনেক পাটকল বন্ধ করে দেয় সেসব সরকার। সর্বশেষ ২০০৬ সালের পরে এসে সিরাজগঞ্জে কওমি পাটকলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে হাজারো শ্রমিক চাকরি হারায় এবং তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে। পরে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসে শিল্প ও কলকারখানা চালু করার ক্ষেত্রে কিছু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় আস্তে আস্তে আর্থিক প্রণোদনা, কর অবকাশসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আবারও সহজ শর্তে সেই পাটকলগুলো খুলে দিতে থাকে। সেই সঙ্গে সরকার পাটের বহুমুখীকরণে উৎসাহ প্রদান শুরু করে।
পাট একটি পরিবেশবান্ধব দ্রব্য। আমরা যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে শুধু একটি দিকে তাকাই অনেক চিত্র পাওয়া যেতে পারে। সেটি হলো পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহারের পরিবর্তে ক্ষতিকর পলিথিন ব্যবহার করা। কারণ দেখা গেছে, পলিথিন এমন একটি জিনিস, যাকে যেভাবেই ব্যবহার করি না কেন তার ক্ষতি থেকে কোনোভাবেই বাঁচা সম্ভব নয়। কারণ পলিথিন এমন একটি রাসায়নিক বস্তু যা পচনশীল নয়। সে জন্য এর কোনো বিনাশ নেই। এমনকি এটি পোড়ালেও দুর্গন্ধ হয়ে ধোঁয়া দিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। এটি যেখানে পড়ে থাকে সেখানেই কৃষি ফসলের জমিতে মাটির রস চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন খাল-বিল, নদী-নালা, ড্রেন, নর্দমাÑ সব জায়গায় পরিত্যক্ত পলিথিন জমে জমে পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে থাকে।
সে জন্যই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে শুধু বাংলাদেশে নয়, আমাদের প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে ক্যারিং ব্যাগ হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ অনায়াসে ব্যবহার করছে। আর দীর্ঘদিন যাবৎ পাটের বিকল্প হিসেবে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হয়ে আসছিল। সে জন্য সময়ের দাবি ছিল পাট দিয়ে পলিথিন তৈরি করতে পারা। ইতোমধ্যে সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন বাংলাদেশেই পাট দিয়ে পলিথিন তৈরি হচ্ছে। আস্তে আস্তে তা ব্যাপকতা লাভ করলে কৃত্রিম পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। কারণ পাটের তৈরি পলিথিন সহজেই মাটির সঙ্গে পচে গিয়ে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না।
পাটের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। ছোট-বড় সব ধরনের পাটগাছ থেকে পাতা দিয়ে পুষ্টিকর পাটশাক খাওয়া যায়। এ পাটশাক শুকনো হিসেবেও দীর্ঘদিন ঘরে সংরক্ষণ করে খাওয়ার সুযোগ থাকে। পাটের পুরো মৌসুমে ক্ষেতের মধ্যে যে পাতা পড়ে, তা ওই জমির জৈব পদার্থ যোগে উর্বরতা বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। পাটের শিকড়, গাছ, পাতা থেকে সার যোগ হলে পরবর্তী ফসল আবাদে ওই জমিতে আর কোনো বাড়তি সার প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না।
পাটের আঁশ ছাড়ানোর ফলে সেই আঁশ সংগ্রহ করে মূলত পাট তুলে নিতে হয়, যা আঁশ হিসেবে কাজে লাগানো হয়। সেই আঁশ ছাড়ানোর পর পাটশোলাকে প্রথমে জ্বালানি এবং পরে কাগজ তৈরি, বাড়িঘর তৈরি, হার্ডবোর্ড, অনেক ফার্নিচার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তা ছাড়া ইদানীং পাটশোলা পুড়িয়ে তা দিয়ে ফটোকপি ও কম্পিউটার প্রিন্টারের কালি প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। পাটশোলার কয়লা ও ছাই দিয়েও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। এগুলোর বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর এগুলো বিদেশে রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
ঢাকাই মসলিন, সিল্কের শাড়ি কিংবা কাপড় যেমন নামে-ডাকে গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক পাটের তৈরি অনেক জিনিসপত্রও এখন দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাট দিয়ে এখন শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার, কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতোয়া, বাহারি ধরনের ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনার বক্সসহ এমন কিছু নেই যা পাট দিয়ে হয় না। প্রায় ১৩৭ ধরনের জিনিস পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে। এমনকি পাট দিয়ে এখন নানারকম গহনাও তৈরি করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে পাটের গুরুত্ব বেড়ে এর বাজারমূল্য বাড়ার কারণে পণ্যটির সুদিন ফিরছে। সে জন্য জাতীয় সংসদে পাট নিয়ে আলোচনা করার সময় স্পিকার ঠাট্টার ছলে পাটের শাড়ি উপহার চেয়ে পাঠালে পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে পাটের তৈরি শাড়ি উপহার দেওয়া হয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
ইতোমধ্যে পাটের উন্নয়নের জন্য ড. মাকসুদুল আলম বৈজ্ঞানিকভাবে এর জীবনরহস্য আবিষ্কার করেছেন। বর্তমান সরকার পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহারে মোড়কীকরণ করে বাজারজাতকরণে বাধ্য করা হয়েছে ১৭টি পণ্যে। তা ছাড়া পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাট চাষেও কৃষকদের ভর্তুকি প্রদানের জন্য এবং বৈজ্ঞানিকভাবে পাট সংগ্রহ ও কম পানিতে পাট পচানোর কৌশল শিক্ষা দেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে ভারত হলো আমাদের দেশ থেকে পাট আমদানির অন্যতম একটি দেশ। সম্প্রতি সেখানে বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানির ক্ষেত্রে যে অ্যান্টি-ডাম্পিং ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে, সেটিও কমানো এবং প্রত্যাহার করার জন্য ভারতের সঙ্গে এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে দেনদরবার চলমান রয়েছে।
পাটের গুরুত্বের বিষয়টি প্রকাশের জন্য সরকারের যে আন্তরিকতা তা প্রশ্নাতীত। কারণ বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ২০১৭ সালেই সর্বপ্রথম ৬ মার্চকে জাতীয় পাট দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে। পাট দিবসের সেøাগান ছিলÑ ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ, পাট পণ্যের বাংলাদেশ।’ তা ছাড়া ‘বাংলার পাট, করবে বিশ্বমাত’ নামের শিরোনাম তো রয়েছেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ মার্চ ২০১৭ রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউিশন মিলনায়তনে প্রথমবারের মতো জাতীয় পাট দিবস উদযাপন উদ্বোধন করেন। সেখানে তিনি পাটের তৈরি শাড়ি পরে এবং পাটের তৈরি ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে এসেছিলেন বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে এ উপলক্ষে ৯ থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত তিন দিনের পাটপণ্য মেলা উদ্বোধন করেন। সেখানে পাট চাষ, পাটের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার, পরিবেশগত উপকারিতা, রপ্তানিতে উৎসাহ প্রদান, অর্থনৈতিক লাভ ও আয় ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এত পাটের বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে।
কাজেই সরকারের আগ্রহ, মানুষের সচেতনতা, ব্যবহারের বহুমুখিতা, অর্থনীতিতে গুরুত্ব, পাটের বর্তমান উচ্চমূল্য, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও ব্যবহার ইত্যাদি নানা কারণে পাট যে এখন আবারও গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেটি ধরে রাখতে হলে এর ওপর গবেষণা ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ আমাদের রূপকল্প-২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়ন করতে হলে পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক অগ্রগতির কোনো বিকল্প নেই। আর রপ্তানি পণ্যের মাধ্যে যদি তৈরি পোশাকের সঙ্গে আবারো পাটকে ফিরিয়ে আনা যায় তবে অগ্রগতি টেকসই হবেই।