কাকডাকা ভোর। মাটির রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছি। দুই পাশে সবুজ ধানক্ষেত বসন্তের বাতাসে খেলা করছে। গন্তব্য জামালপুর জেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের রুহিনী গ্রাম। খানিকটা যেতেই বেলা উঠল। দলে দলে নারীরা শুকনো মরিচ নিয়ে রাস্তার দুই ধারে, খোলা মাঠে ও ধানক্ষেতের পাশের জায়গায় কাপড়, চট বিছিয়ে শুকাতে দিচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, খানিকটা লাল রং লেপ্টে রাখা হয়েছে। লাল-সবুজের খেলা দেখতে দেখতে রুহিনী গ্রামে বিজনেস সেন্টার নামে পরিচিত একটি মাঝারি মাপের টিনের ঘরের সামনে গিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। সকাল ৮টা বেজে গেছে। পাঁচজন নারী আলোচনা করছেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন, কুশল বিনিময়ের পর ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসতে দিলেন।
চারপাশে নজর বুলিয়ে নিলাম। দেয়ালে নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কিছু কথা লেখা। পাশে চাষবাস পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনাবলি। ঘরের এক পাশে একটি টেবিলের ওপর ল্যাপটপ রাখা। পাশে প্রিন্টার। ঘরের আরেক পাশে আরেকটি ছোট্ট টেবিলের ওপর দুটি মোবাইল ফোনসেট। আরেকটি টেবিলে প্রেসার মাপার যন্ত্র। ঘরের মধ্যে সেলাই মেশিন ও তার ঠিক পাশেই কিছু গজ কাপড় রয়েছে। ঘরের সামনে তাকে তাকে সাজানো সার, বীজ, কীটনাশক, চাল-ডাল প্রভৃতি পণ্য।
পাঁচ নারীর নাম শাপলা, নূরজাহান, সালমা, নাসিমা ও জাহিদা। তাঁরা ২০১৫ সালে একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। তাঁদের একত্র করে ইউনাইটেড পারপাস নামের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কোকা-কোলা কম্পানি সহযোগিতায় ছিল। সংস্থাটি এই নারীদের সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেয় না। তবে নানা উপায়ে সহযোগিতা করে। প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের মাধ্যমে এ গ্রামের আরো এক হাজার নারীর কাছে তাদের বার্তা পৌঁছে দেয়। ১৮ মাস পর সংস্থাটি এই নারীদের আর কোনো সেবা না দিলেও যেকোনো সমস্যায় পাশে থাকে। পাঁচ নারী এখন নিজেরাই পথ চলছেন।
ইউনাইটেড পারপাস নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা করে। নারীদের শেখায় কিভাবে আত্মনির্ভরশীল হওয়া যায়। কিভাবে নিজে সচ্ছল হলে পরিবারকে ভালো রাখা যায়। সন্তানকে কিভাবে লেখাপড়া শেখানো যায়, তাদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি করা যায়।
শাপলা কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করেন। নূরজাহান স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন। সালমা কৃষি সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে থাকেন। নাসিমা ল্যাপটপ চালিয়ে গ্রামের মেয়েদের বিভিন্ন কাজ করে দেন। জাহিদা মোবাইল ফোনের সেবা দেন। তাঁরা আয়ের অর্থ একসঙ্গে রাখেন। মাস শেষে লাভের টাকা পাঁচ ভাগ করেন।
কথা বলতে বলতে বেলা বাড়তে থাকে। বিজনেস সেন্টার নামের টিনের ঘরের সামনে ভিড় বাড়তে থাকে। গ্রাহক বা ক্রেতাদের সবাই নারী। কেউ নিত্যপণ্য কিনতে এসেছে। কেউ বীজ বা সার কিনছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এসেছে ল্যাপটপে টাইপ করতে বা মেইল করতে। কেউ কেউ টাইপ করিয়ে প্রিন্ট নিচ্ছে। এর মধ্যেই এক মা এলেন। তিনি তাঁর মেয়েকে নিয়ে গজ কাপড় কিনে জামা বানাতে দিলেন। এভাবে দুপুর পর্যন্ত চলল। পাঁচ নারীর কেউ কাজের ব্যস্ততায় কথা বলার সময়টুকু পাচ্ছেন না।
দুপুরে ঘণ্টাখানেক সময়ের জন্য বিজনেস সেন্টারের সামনের দরজা টেনে দেওয়া হলো। ৩টা বাজতে না বাজতে আবার পাঁচ নারী একে একে জড়ো হলেন সেন্টারে।
এবার চিত্রটা খানিকটা ভিন্ন। বিকেল ৪টায় ২৫-৩০ জন নারী সেন্টারের সামনে জড়ো হলো। চট বিছিয়ে তারা বসল। ১৪-১৫ বছরের কিশোরী থেকে ৬০-৬৫ বছরের বৃদ্ধা আছেন এ দলে। নূরজাহান তাদের সামনে একটি প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে বসলেন। নারী স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রাথমিক কিছু কথা বলতে শুরু করেন তিনি। কিভাবে গর্ভবতী নারী নিজের ও সন্তানের যত্ন নেবেন, কিশোরী মেয়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কী ধরনের সমস্যা হলে কী করতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কেন জরুরি এবং কিভাবে তা রক্ষা করতে হয়—এসব বিষয়ে বলছেন তিনি। অনেকে প্রেসার মাপাল তাঁর কাছে। অনেকে একান্তে আরো কিছু জানতে চাইল। সেবার বিনিময়ে কিছু ফি দেওয়া হলো তাঁকে। সেই টাকা বিজনেস সেন্টারের তহবিলেই জমা করে দিলেন তিনি।
নূরজাহান বললেন, ‘ইউনাইটেড পারপাস থেকে স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রতিদিন ২৫ জনের একটি দলকে স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রাথমিক তথ্য জানাই। বড় ধরনের স্বাস্থ্যসেবা দিতে অনেক সময় গ্রামের বড় চিকিৎসককে নিয়ে আসি। তাঁদের আমরা কম টাকা নিতে অনুরোধ করি। ’
সালমা বলেন, ‘নারীরা একত্র হয়ে কাজ করলে অনেক সমস্যার সহজে সমাধান করা সম্ভব হয়। আমাদের পথ দেখিয়েছে ইউনাইটেড পারপাস ও কোকা-কোলা। তাদের দেখানো পথে আমরা চলছি। পরিবারে আমাদের মর্যাদা বাড়ছে। আমরা এখন জানি, কিভাবে সুষ্ঠুভাবে সংসার ও সন্তান সামলাতে হয়। প্রতি মাসে সংসারে টাকা দিই। সহযোগিতা করতে পারায় স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি আমাদের ওপর খুশি। আমাদের প্রত্যেকের সন্তান স্কুল-কলেজে ভালো ফল করছে। আমাদের মাধ্যমে এক হাজার সেবাগ্রাহী তৈরি হয়েছে। তারাও আমাদের মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছে। ’
প্রসঙ্গত, ইউনাইটেড পারপাস ও কোকা-কোলা যৌথভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে এমন মডেল নারীকর্মী তৈরির কাজ করছে।