দিন যায় মাস আসে। মাস যায় বছর আসে। এভাবে ঘোরাফেরার মধ্য দিয়ে বছর যাচ্ছে-আসছে। রক্ষণশীল সমাজের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নানা প্রতিক‚লতা পেরিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে একটার পর একটা সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে চলেছে বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদরা। বাংলাদেশের নারী চার দেয়াল থেকে বের হয়ে এসে চারদিকে আলো ফেলছে। তাদের কেউ আর আগের মতো অবরোধবাসিনী বলবে না।
নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একমাত্র বাংলাদেশেরই প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্পিকার নারী। এ ছাড়াও দেশে মন্ত্রী, বিচারক, সচিব, পুলিশ কর্মকর্তা, প্রধান দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নারী (জাহাঙ্গীর নগর ও বুয়েট)। হিমালয় পর্বত জয় করেছেন আমাদের নারীরা।
যে কোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হয়। খেলাধুলার ক্ষেত্রে কথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। ভারোত্তোলন, সাঁতার, টেবিল টেনিস, দাবা, শুটিং, ফুটবল এবং ক্রিকেটে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা ক্রীড়াবিশ্বে দাপটের সঙ্গে লড়াই করে জাতির জন্য সুনাম বয়ে আসছে। প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম লিখিয়েছিলেন টেবিল টেনিস খেলোয়াড় জোবেরা রহমান লিনু। দাবা অঙ্গনে রানী হামিদ এবং শামীমা আক্তার লিজা দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন। শুটিংয়ে বাংলাদেশকে একাধিক স্বর্ণপদক এনে দিয়েছেন সাবরিনা সুলতানা, শারমিন আক্তার রতœা এবং সাদিয়া সুলতানা। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) বাংলাদেশ দল চারটি স্বর্ণ পদক জিতেছে। এই চার স্বর্ণের তিনটিই জয় করেছেন ভারোত্তোলক মাবিয়া আকতার সীমান্ত এবং সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা। বাংলাদেশের মেয়ে ক্রিকেট দল দাপটের সঙ্গে বিশ্ব ক্রিকেট মাতিয়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশের তিন মেয়ে ফুটবলার গোলরক্ষক সাবিনা আক্তার, মিডফিল্ডার মিরোনা ও ফরোয়ার্ড সাবিনা খাতুন গত বছর মালদ্বীপে খেলে এসেছেন। এবার দুবাইয়ে খেলার প্রস্তাব পেয়েছেন সাবিনা। ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েরা আজ আর পিছিয়ে নেই। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মেয়েরা যে আশার আলো দেখাচ্ছে তাতে মুগ্ধ ফুটবলানুরাগীরা। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মেয়েদের চ্যাম্পিয়নশিপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষদের চেয়ে বাংলাদেশের মহিলা দলই কাবাডিতে সাফল্য পাচ্ছে বেশি। গত দুটি এশিয়ান গেমসে দুটি ব্রোঞ্জ, সর্বশেষ তিনটি দক্ষিণ এশিয়ান গেমস থেকে দুটি রুপা, একটি ব্রোঞ্জ ও তিনটি এশিয়ান বিচ গেমসে তিনটি ব্রোঞ্জ জিতেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। জাতীয় খেলা কাবাডির মর্যাদা এখন মেয়েদের হাতে। এ দেশের মেয়েরা ক্রিকেটের ২২ গজে লাল-সবুজের পতাকা ওড়াবে, তা কল্পনা করাটাও ছিল বাড়াবাড়ি। সময়ের ব্যবধানে সেটাই এখন বাস্তব। অবশ্য শুরুতে ক্রিকেট খেলে এমন মেয়েদের খুঁজে বের করাটাই ছিল কঠিন। আর ২২ গজে ঠিকানা গড়তে যারা এসেছিল তারাও ছিলেন একেবারেই আনফিট, অযোগ্যদের দলে। তাদের অনুশীলন দেখে অনেকেই তখন হেসেছিলেন। দিনে দিনে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, সে কারণেই ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের মেয়েরা এখন আলোচিত এক নাম। দাবা বুদ্ধির খেলা। এ খেলা মেধা বিকাশে অন্যতম সহযোগী। এই মেধা খাটিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরো এগিয়ে যাবে। এতে বাংলাদেশ থেকে আরো গ্র্যান্ড মাস্টার বের হয়ে আসবে। মেয়েদের দাবায় ক্রমে প্রতিযোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আগের চেয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা বুদ্ধির খেলায় বেশি আগ্রহী হচ্ছে। সার্ফিং মানে ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ। বড় বড় সব ঢেউকে জয় করে যেই এগিয়ে যেতে পারবে সেই হবে জয়ী। বেঁচে থাকা মানেই সংগ্রাম করা যেন প্রতি মুহূর্তে আচমকা আসা ঢেউগুলোকে পাড়ি দিয়ে যেতে হবে বহুদূর। আর সার্ফিং খেলাটাই জীবনযাত্রার সঙ্গে মিল সবসময়। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের মেয়ে সার্ফাররা এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদ হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ নাম তোলেন জোবেরা রহমান লিনুর। ১৯৭৭ থেকে ২০০১-এর মধ্যে ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তিনি এ কৃতিত্ব অর্জন করেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি ইউনিসেফের বিশেষ দূত নির্বাচিত হয়েছেন। শৈশব থেকে দাবার বোর্ডের দিকে দারুণ ঝোঁক ছিল রানী হামিদের। ঝোঁকটা আরো বেড়ে গেল যখন দেখলেন, বাবা মমতাজ আলী প্রতি সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে দাবা খেলতেন। স্কুল জীবনে ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও অ্যাথলেট হওয়া সত্ত্বেও দাবাই ছিল রানীর প্রধান ভালোবাসা। ১৯৭৭ সালে প্রথম দাবার ওপর মেয়েদের টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। তার স্বামী ওই খেলায় রানী হামিদকে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ দেন। রানী হামিদ ওই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর ১৯৭৯ সালে ঢাকায় প্রথম উন্মুক্ত দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর দাবা খেলার প্রতি তার উৎসাহ বেড়ে যায়। এ পর্যন্ত আটবার জাতীয় ও তিনবার ব্রিটিশ মহিলা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তিনি। এ উপমহাদেশে তিনিই একমাত্র নারী যিনি তিনবার ব্রিটিশ শিরোপা অর্জনের গৌরব লাভ করেন। দাবা অঙ্গনে দ্বিতীয় নারী আন্তর্জাতিক মাস্টার শামীমা আক্তার লিজা। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলার মতো সাফল্যও লাভ করেছেন। বাংলাদেশ গেমসের দাবা ইভেন্টের নারী এককে শিরোপা জেতেন। শুটিংয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা বরাবরই ভালো ফলাফল করে থাকে। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণ জিতে সবাইকে অবাক করে দেন সাবরিনা সুলতানা। ২০১০ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে সবাইকে পেছনে ফেলে স্বর্ণ জয় করেন শারমিন আক্তার রতœা এবং সাদিয়া সুলতানা।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশ গেমসের মাধ্যমে সাবরিনার বড় টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ শুরু। ১৯৯৩ সালের ঢাকা সাফ গেমসেও অব্যাহত থাকে সাবরিনার সাফল্যের ধারা। প্রোন ইভেন্টে দলগত স্বর্ণ ছিল সাবরিনার প্রথম আন্তর্জাতিক পদক। ১৯৯৬ সালের বাংলাদেশ গেমসে প্রোন ও থ্রি পজিশনে স্বর্ণ জিতলেও প্রিয় ইভেন্ট রাইফেলে রৌপ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়া কমনওয়েলথ গেমসে সাবরিনা স্বর্ণ জয় করেন। ২০১০ সালে কমনওয়েলথ শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ জেতেন শারমিন আক্তার রতœা এবং সাদিয়া সুলতানা। গত বছর ভারতে অনুষ্ঠিত ১২তম এসএ গেমসের তৃতীয় দিনে দুটি স্বর্ণ জিতেছে বাংলাদেশ। লাল-সবুজের পক্ষে প্রথম স্বর্ণ জয় করেন নারী ভারোত্তোলক মাবিয়া আকতার সীমান্ত। আর দ্বিতীয় ¯¦র্ণ জিতেছেন সাঁতারু মাহফুজা খাতুন। যত দিনই যাচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশে মেয়েরা দেশের সম্মান বৃদ্ধি করছে।