নারী-পুরুষে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে অবিচল বাংলাদেশ

নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। কেননা নারীর অধিকার মানবাধিকারেরই নামান্তর। ২০৩০ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মানবাধিকার, মর্যাদা ও সমতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা । শুধু তাই নয়, এটি মানব উন্নয়নসহ সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (২) নং অনুচ্ছেদে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী ও পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন’।

এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ওম্যান ইন দ্য চেঞ্জিং ওয়াল্ড অব ওয়ার্ক : প্লানেট ৫০:৫০ বাই ২০৩০’। ব্যক্তি জীবনে নারীর নিরাপত্তার পাশাপাশি কর্মপরিবেশও নিরাপদ হওয়া দরকার। কর্মক্ষেত্রে নারী নানাভাবে নির্যাতন, হয়রানির সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে দেখা যায়, নারী ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। এভাবে হয়তো নারীর উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতায়ন হয়নি। ঘরে-বাইরে নারী দ্বিগুণ বোঝা নিয়ে কাজ করছে। নারীরা যদি বাইরের দায়িত্ব নিতে পারে তাহলে পুরুষদেরও ঘরের দায়িত্ব নিতে হবে। আইন, নীতিমালা নারীর সুবিধাগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে এখন পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে নারী শ্রমিকের শ্রমের মূল্য কম। শহরে নারীর চাকরির অন্যতম প্রধান খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। অল্প মজুরিতে নারীরা এই পোশাক শিল্পে কাজ করেন। রপ্তানিমুখী শিল্পে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বেশি হলেও মজুরির ক্ষেত্রে তারা পুরুষ শ্রমিকের সমান পায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, অকস্মাৎ বিনা নোটিশে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিককেই আগে চাকরিচ্যুত করা হয়। কাজের মজুরিও দেয়া হয় না। নারীর কাজকে এভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের সমান মূল্যায়ন করা হয় না। শ্রমের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই অসমতা আজও বিদ্যমান।

জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি এ প্রসঙ্গে বলেন, নারীর সমতা প্রতিষ্ঠায় পুরুষতান্ত্রিকতার মূলোৎপাটন এবং নারীর শত্রু জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নারীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। বাল্যবিয়ে নারীর অধিকার, মানবাধিকার, ক্ষমতায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যেখানে বার বার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে সচেতন হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের তার মেয়েশিশুকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো, লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বেড়ে ওঠার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সেখানে সম্প্রতি বিশেষ বিধান বহাল রেখেই জাতীয় সংসদে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ পাস হয়েছে। যে মেয়েটি নিজেই একজন শিশু সে আরেকটি অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেবে। এরপর মেয়েশিশুটি অকাল মাতৃত্বজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগবে।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, এ সরকারের মাধ্যমে আমরা বেশ কিছু ভালো আইন পেয়েছি। কিন্তু সব আইনের সঠিক প্রয়োগ দেখিনা। আইন তৈরি হয় অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য। কিন্তু সেই আইন যখন নতুন কোনো অপরাধের জন্ম দেয় তা মেনে নেয়ার মত নয়। আমরা এই আইন পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছি।

সিডও সনদের ধারা ১১

বাংলাদেশের কর্মজীবী নারী

প্রত্যেক নারীই কর্মজীবী। ঘরে নারী মজুরিবিহীন গৃহস্থালির কাজ করেন। মজুরিভিত্তিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর শ্রম ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজে মজুরিভিত্তিক শ্রম মিলেই বাংলাদেশের নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে সচল রেখেছেন।

সিডও সনদে স্বাক্ষরকারী এবং অনুমোদনকারী দেশ হিসেবে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে নারীর কর্মসংস্থান বিষয়ক ১১ নং ধারা বাস্তবায়নে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই ধারার শুরুতেই কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ করার কথা বলা হয়েছে। নারীর জন্য কাজের সহায়ক পরিবেশ, অনানুষ্ঠানিক খাতে মজুরির সমতা, ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতে ছুটি, শিশু রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, সন্তান ধারণকালীন সময়ে বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান নীতিমালা ঘোষণা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের জন্য বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। সিডও কমিটির ১৭ নং সাধারণ সুপারিশে সিডও ধারা ১১-এর অনুকূলে নারীর বিনা পারিশ্রমিকে গার্হস্থ্য কাজের বিষয়ে উল্লেখ করে নারীর এই কাজের অর্থনৈতিক মূল্য পরিমাপের কথা বলা হয়েছে। এখানে এও বলা হয়েছে, নারীর ঘর-গেহস্থালির কাজ দেশের অগ্রগতিতে বড় অবদান রাখে এবং এই কাজের মূল্যায়ন অর্থনীতিতে নারীর সত্যিকার ভূমিকাকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরবে।

সিডও ধারা ১১ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮

২০৩০ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য- এসডিজি’। এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য অবশ্য প্রয়োজন সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন। এসডিজি’র বিভিন্ন লক্ষ্য বিশেষ করে নারী পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত ৫ নং লক্ষ্যের সঙ্গে রয়েছে সিডও সনদের প্রতিটি ধারার সম্পর্ক। নারীর কর্মসংস্থান সম্পর্কিত ১১ নং ধারার প্রতিফলন ঘটেছে এসডিজির ৮ নং লক্ষ্যে। এতে সব নারী-পুরুষের জন্য উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান, মানসম্পন্ন কাজ, সমমানের কাজে সমমজুরির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে সবাইকে উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে যুক্ত করতে হবে- কেউ যেন পেছনে পড়ে না থাকে।

বাংলাদেশ সরকার এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অঙ্গীকার করেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তাই নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে সিডও সনদের ধারা ১১’র পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮ পূরণের জন্যও সিডও সনদের এই ধারাটির বাস্তবায়ন অপরিহার্য। সিডও সনদের নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বাংলাদেশের সংবিধানের নীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ সরকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে ঘোষণা করেছে ভিশন ২০২১। ২০২১-এর স্বপ্ন পূরণে জরুরি প্রয়োজন সিডও সনদের ২ ও ১৬.১ (গ) ধারা থেকে সরকারের সংরক্ষণ প্রত্যাহার এবং স্বীকৃত ধারাগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন। ২০১৫ পরবর্তী স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন এজেন্ডায় ইতিমধ্যে সংযুক্ত জেন্ডার সমতার সামগ্রিক ও স্বতন্ত্র লক্ষ্যমাত্রা পূরণের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠাই নিশ্চিত করবে বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ এক ৫০: ৫০ পৃথিবী।