পাটে বহুমুখী উদ্যোগ

দেশে পাটের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে- এ খাতে গবেষণা বাড়ানো, নতুন পাটনীতি প্রণয়ন, সংস্কারের আওতায় আসছে জুটমিল কর্পোরেশন এবং পণ্যের ব্যবহার পলিথিনের ওপর ইকো ট্যাক্স আরোপ। সেব উৃদ¿াৃগর দুটি উৃ­শ। একদিকে দেশে পাট পণ্যের ব্যবহার বাড়ানো এবং অন্যদিকে রফতানি বাড়ানো। সব মিলে এ খাতের বিশাল বাজার সৃষ্টি করে কর্মসংস্থান বাড়াতে চায় সরকার।
পাট সম্প্রতি বাংলাদেশ জুটমিল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) জন্য ২৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট থেকে তা সমন্বয় করা হবে। এছাড়াও পাটের গুরুত্ব তুলে ধরতে আগামীকাল সারা দেশে জাতীয় পাট দিবস পালন করা হবে। ফলে পাটখাতে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। আর এসব কিছু বাস্তবায়ন হলে আগামীতে এ খাতের জন্য বিশাল সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে।
জানা গেছে- ২০১৩ সালে দেশীয় পাটের জন্মরহস্য আবিস্কার করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। ফলে জীবাণু প্রতিরোধক পাট উৎপাদন করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি দেশী পাট দিয়ে বস্ত্রশিল্পের উপযোগী সুতা উৎপাদন করাও সম্ভব হবে। ২০১৮ সালের মধ্যে সুফল পাওয়া যাবে। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতেই নানা উদ্যোগ। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, জন্মরহস্য আবিস্কার হওয়ায় পাটের সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। বিশ্ববাজারেও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। ফলে এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এ খাতে বিনিয়োগ জরুরি। তিনি বলেন, এ খাতে গবেষণা আরও বাড়াতে হবে।
এদিকে পলিথিনের মোড়ক ব্যবহার করে পণ্য বাজারজাত করে এমন কোম্পানির ওপর এক শতাংশ ইকো ট্যাক্স আরোপ করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে অবৈধ পলিথিন নির্মূল ও পলিথিন রি-সাইক্লিং সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কমিটি পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা প্রচারের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট তারিখ থেকে পাক্ষিক কার্যক্রম গ্রহণ করে উৎপাদনকারী, বিক্রয়কারী এবং ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে।
অন্যদিকে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় পাট দিবস পালন করবে সরকার। সোনালি আঁশের সোনার দেশ/পাট পণ্যের বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে আগামী ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস-২০১৭ পালন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে আট দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সোনালি আঁশ পাটের সম্ভাবনাগুলো বিকশিত করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের জন্য পাট সংশ্লিষ্ট সব উদ্যোগকে সমন্বিত করা এবং সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডার, পাটচাষী ও শ্রমিক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দফতরের কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ে সরকার পাট দিবস হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা দিয়েছে। মির্জা আজম জানান, পাটজাত পণ্যের উদ্যোক্তরা এ পর্যন্ত ১৩৫ রকমের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করেছে। পাট দিবসের গুরুত্ব এবং পাট-সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টিতে ইতিমধ্যে সারা দেশে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে রচনা প্রতিযোগিতা হয়েছে। রচনা প্রতিযোগিতায় দেশের আটটি বিভাগ থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারী মোট ২৪ জনকে প্রধানমন্ত্রী পুরস্কৃত করবেন। এছাড়া সেরা পাটচাষী, সেরা পাটবীজ উৎপাদনকারী, বেসরকারি সেরা পাটকল, সেরা কাঁচাপাট রফতানিকারক, সেরা পাটসুতা রফতানিকারক, সেরা বহুমুখী পাটপণ্য রফতানিকারক, সেরা উদ্যোক্তা ও সেরা পাটপণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানসহ আট ক্যাটাগরিতে এবং পাটসংশ্লিষ্ট গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য ২ জন ব্যক্তিকে পুরস্কার দেয়া হবে’ বলেন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৯ দশমিক ৬২ লাখ বেল পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ৭ হাজার ২৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা আয় করেছে। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৮৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা বেশি।
জানা গেছে, দেশে মোট কাঁচাপাটের উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ বেল। অভ্যন্তরীণ চাহিদা হচ্ছে ৬৩ লাখ বেল। যা মোট উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ। পাশাপাশি বিদেশে কাঁচাপাট রফতানি হচ্ছে বছরে ১২ লাখ বেল। অবশিষ্ট ৭ থেকে ১০ লাখ বেল ব্যবহার হচ্ছে গৃহস্থালি কাজে।
সূত্র মতে, বিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে চীনের দখলে অধিকাংশ বাজার থাকলেও বাংলাদেশের অবস্থান আছে ছোট আকারে। তবে ২০১৮ সালে ইউরোপের বাজারে সিনথেটিক পণ্য নিষিদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বাড়ছে বায়োডাইবারফিকেশন ব্যাগ ও পণ্যের চাহিদা। যা বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সূত্র আরও জানায়, পাটখাতে এখন বেশ সাড়া মিলেছে। এজন্য প্রায় একদশক পরে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। এই নীতিতে বন্ধ হওয়া সরকারি পাটকলগুলো ক্রমান্বয়ে চালুর ব্যবস্থা করা হবে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যেই তা করা হচ্ছে। খসড়া নীতিমালায় সরকারের এ ধরনের দৃঢ় অবস্থানের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। সেখানে আরও উল্লেখ্য করা হয়, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার এবং পাটপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। পাট বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় বিএডিসির সক্ষমতা বাড়ানো, পাটচাষীদের অর্থ সংকট লাঘবে সহজশর্তে ঋণ প্রদান, বিক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাটচাষীরা অর্থ পেয়ে যান- এসব বিষয় খসড়া পাটনীতিতে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হচ্ছে।
বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, আইভরি কোস্ট, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, জার্মানি, স্পেন, ইংল্যান্ড, মিসর, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। দেশের ভেতরেও পাটজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে বেসরকারি পাটকলগুলো।
তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি এ খাতে সমস্যাও কম নেই। উন্নত জাতের বীজ, আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, দক্ষ শ্রমিক, পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও বিপণন কৌশলের অভাব রয়েছে পাট শিল্পে। সহযোগিতাও নেই পাট গবেষণায়। এসব দিকে এখনই নজর না দিলে বিশ্ববাজারে অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সরকারের সহযোগিতা পেলে এ খাত ছাড়িয়ে যেতে পারে তৈরি পোশাক শিল্পকে। এ জন্য গুরুত্ব দিতে হবে বীজ উৎপাদনে। কারণ মান সম্মত বীজের অভাব রয়েছে।
জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে সাড়ে ১২শ’ টন উৎপাদন হলেও পাট বীজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় পাঁচ হাজার টন। ফলে ভারত বা চীন থেকে প্রতিবছর বীজ আমদানিতে চলে যাচ্ছে বড় অংকের অর্থ। তবে পাটখাতে সরকারি বিনিয়োগে অসন্তোষ অবস্থানে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ সংস্থার মতে, অদক্ষতা, লুটপাট, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে লোকসানি মিলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে নতুন করে পাটের পুনঃজাগরণের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতের (পিপিপি) ভিত্তিতে পুনরায় পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।