‘সাবধান! ট্রেন আসছে, সাবধান! ট্রেন আসছে। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এই ক্রসিংটি অতিক্রম করবে…’ এভাবেই সতর্কবার্তা বাজতে থাকবে ট্রেন সিগন্যালে
‘সাবধান! ট্রেন আসছে, সাবধান! ট্রেন আসছে। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এই ক্রসিংটি অতিক্রম করবে…’ এভাবেই সতর্কবার্তা বাজতে থাকবে ট্রেন সিগন্যালে
ট্রেনলাইন পারাপারে দুর্ঘটনা এড়াতে ‘ডিজটাল ভয়েস অ্যালার্ট ফর লেভেল ক্রসিং’ সেবা উদ্ভাবন করেছেন দেশের ছয় তরুণ। তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পথচারীদের সতর্কতায় তিন স্তর বিশিষ্ট এ প্রযুক্তি নিয়ে লিখেছেন ইমদাদুল হক
বন্ধুসহ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি একুশে গ্রন্থমেলায় ঘুরতে ঢাকায় আসেন আকাশ। এরপর বাসায় ফেরার জন্য সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে গাজীপুরগামী একটি ট্রেনে উঠতে তেজগাঁও রেলস্টেশনে যাওয়ার পথে রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাথায় গুরুতর আঘাত পান তিনি। উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। এভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন পথচারী থেকে শুরু করে বাস-রিকশার আরোহীরাও। এ ধরনের অপমৃত্যু রোধে প্রযুক্তি সেবা নিয়ে এসেছেন ছয় তরুণ উদ্যোক্তা। তারা উদ্ভাবন করেছেন রেল দুর্ঘটনারোধী প্রযুক্তি-বিডি-ভ্যাস বা বাংলা ডিজিটাল ভয়েস অ্যালার্ট ফর লেভেল ক্রসিং।
‘সাবধান! ট্রেন আসছে, সাবধান! ট্রেন আসছে। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এই ক্রসিংটি অতিক্রম করবে। আপনারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করুন। মনে রাখবেন সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সাবধান! সাবধান! সাবধান!, জনস্বার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে।’
উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের জালাল উদ্দীন সরণি সংলগ্ন বটতলা রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় এই সতর্ক বার্তা কানে বেজে আসে। রেলক্রসিং দুর্ঘটনা এড়ানোর এই যুগপৎ ডিজিটাল সমাধানটির নাম বিডি-ভ্যাস বা ‘বাংলা ডিজিটাল ভয়েস অ্যালার্ট সিস্টেম ফর লেভেল ক্রসিং’। এই সল্যুশনটি পথিক অন্ধ কিংবা বধির হলেও তাকে সচকিত করতে পারে আগে ভাগেই। ট্রেন লেভেল ক্রসিং হতে নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা অবস্থায় এই সিস্টেমের জিপিএসসহ মোট তিনটি স্তরের সেন্সিং সিস্টেম ট্রেনকে শনাক্ত করে। একই সঙ্গে লেভেল ক্রসিংয়ে পারাপাররত সব যানবাহন, জনসাধারণ, আশপাশে বসবাসরত জনসাধারণ এবং লেভেল ক্রসিংয়ের কাছাকাছি রেললাইন ধরে হেঁটে চলা জনসাধারণকে সতর্ক ও সাবধান করতে লেভেল ক্রসিংয়ের দুই পাশে স্থাপন করা হয় এলইডি ডিসপ্লে। সেখানে বাংলা অক্ষরে লাল এলইডি বাতিতে স্ক্রল হতে থাকে ট্রেন আসার সতর্কবার্তা। একই সঙ্গে লাউডস্পিকারে মানবকণ্ঠে উচ্চারিত হয় সাবধানবাণী। ট্রেন ক্রসিং অতিক্রম করার আগ পর্যন্ত জ্বলা-নেভা করতে থাকে ‘লাল ফ্ল্যাসিং লাইট’।
বিডি-ভ্যাস উদ্ভাবক দলনেতা রাফায়েত চৌধুরী সমকালকে বলেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিজেদের সমস্যার ডিজিটাল সমাধান উদ্ভাবনে আমরা গড়ে তুলেছি ‘উইভার ইনোভেশন’। উদ্ভাবনের প্রথম ধাপেই আমাদের লক্ষ্য ছিল রেলক্রসিংয়ে অসতর্কতায় যেন হতাহতের ঘটনা না ঘটে। সতীর্থ এম এ হাসান খান, নাজিবুর রহমান, হুমায়ন কবির, শাহ সুফিয়ান মাহমুদ চৌধুরী ও সারোয়ার রশীদ। এই ছয় তরুণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার সেই স্বপ্ন এখন উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের বটতলা ক্রসিংয়ে সতর্ক করছে পথচারীদের।
অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ডিজিটাল সুরক্ষা
পরিসংখ্যান বলছে, দেশজুড়ে দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে কমবেশি দুই হাজার ৫৪১টি রেলক্রসিং আছে। এর বিপরীতে প্রতিবন্ধক ও প্রহরী (গেটম্যান) আছে মাত্র ৪০০টি লেভেল ক্রসিংয়ে। অবশিষ্ট দুই হাজার ১৭০টিতে অর্থাৎ প্রায় ৮৫ শতাংশে কোনো গেট, গেটম্যান বা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা নেই। এর ফলে প্রতিদিনই এসব ক্রসিংয়ে ঝরছে তাজা প্রাণ। দিন দিন এই সংখ্যাটা যেন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এমন সঙ্গিণ অবস্থাদৃষ্টে লাগসই দেশজ প্রযুক্তি উন্নয়নে নিবিড় গবেষণা শুরু করে উইভার ইনোভেশন। ব্যাপক দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি রোধ করতে ২০১৫ সালের শেষ দিকে ‘উইভার ইনোভেশনস’ শুরু করে ‘ডিজিটাল ভয়েস অ্যালার্ট সিস্টেম ফর লেভেল ক্রসিং’ এর কাজ। রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংগুলোর সমস্যার সমাধানে উইভার ইনোভেশনস তাদের ধারণাপত্রটি রেলমন্ত্রী মোহাম্মদ মুজিবুল হকের কাছে উপস্থাপন করেন। অনুমতি নিয়ে নিজস্ব খরচে ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত জালালউদ্দীন সরণি লেভেলে এটি স্থাপন করা হয় পরীক্ষামূলকভাবে। অল্পদিনের মধ্যেই ডিজিটাল উদ্ভাবনী ও জেলা ব্র্যান্ডিং মেলা ২০১৭-তে অংশ নিয়ে শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবকের মর্যাদা অর্জন করে উইভার ইনোভেশনসের বিডি-ভ্যাস। উদ্ভাবকরা জানালেন, পারাপাররত অসতর্ক পথচারী, যানবাহনচালক ও গেটম্যানদের লেভেল ক্রসিংয়ে আগত ট্রেন সম্পর্কে পূর্বেই সচেতন ও সতর্ক করতে স্বয়ংক্রিয় তিনটি আলাদা আলাদা মাধ্যম রয়েছে। সতর্কতার জন্য আছে, এলইডি স্ক্রলিং ডিসপ্লে, লাউড ভয়েস স্পিকার ও রেড ফ্ল্যাসিং লাইট। ট্রেন আসার আড়াই মিনিট আগ থেকেই এই তিনটি মাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার করে বিডি-ভ্যাস। এর ফলে কেউ যদি বধির হয়, তবে তিনি লাল আলোর আর্তি, প্রদর্শিত সতর্কবার্তা থেকে বুঝতে পারবেন এখন আর ক্রসিং লেভেল পার হওয়া যাবে না। আবার চোখ থাকতেও যারা অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন তাদেরকে সাইরেন দিয়ে কিংবা সাবধানবাণী শুনিয়ে সচকিত করতে সক্ষম এই ডিজিটাল সল্যুশনটি।
ত্রিস্তরে সুরক্ষিত বিডি-ভ্যাস
রেলক্রসিংয়ে জীবনের নিরাপত্তা দিতে উদ্ভাবিত ‘বিডি-ভ্যাস’ নিজেই কতটুকু নিরাপত্তা এই প্রশ্ন রেখেছিলাম উদ্ভাবকদের কাছে। তারা জানালেন, আমরা বাবুই পাখি। আর এই দেশটা আমাদের। তাই এর নিরাত্তার বিষয়টিও আমরা নিজেদের নিরাপত্তার মতোই অটুট রেখেছি। সিস্টেমটি সবসময় সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বৈদ্যুতিক চাহিদা মেটাতে এখানে আমরা ব্যবহার করেছি পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুৎ। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ডাটা-তথ্যগুলো আদান-প্রদানের জন্য দুই ধরনের হাই ফ্রিকোয়েন্সি ওয়্যারলেস সিগন্যালিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। ট্রেনের সঠিক এবং নির্ভুল অবস্থান শনাক্ত করতে এতে গ্গ্নোবাল পজিশনিং (জিপিএস) সিস্টেমে ৩২টি স্যাটেলাইট কার্যকর রয়েছে। তিন স্তরের তথ্য-ডাটা ট্রান্সমিশন সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে দুটি হাই ফ্রিকোয়েন্সির বেতার-ওয়্যারলেস সিস্টেম এবং অন্যটি তার-ওয়্যার সিস্টেম। হ্যাকাররাও যেন এই নিরাপত্তা রক্ষাকবচে নাক গলিয়ে ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ‘মোশন সেন্সর’ ও ‘হুইল কাউন্টার’। এর ফলে ক্লাউড যদি তথ্য দেয় তবে মোশন সেন্সর রেলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তারের মাধ্যমে তা পেঁৗছে দেবে সিগন্যাল টাওয়ারে। উদ্ভাবকরা আরও জানালেন, পরীক্ষামূলক সংস্করণে বার্তা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তী সংস্করণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেলক্রসিং সিগন্যালবারও বন্ধ করতে সক্ষম হবে এই বিডি-ভ্যাস।