কর্ণফুলীর চরে শুঁটকি উত্পাদনের ধুম

কর্ণফুলীর চরে শুঁটকি উত্পাদনের ধুমসরোজ আহমেদ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর চরে চলছে শুঁটকি উত্পাদনের ধুম। রাত-দিন শ্রমিকরা শুঁটকি উত্পাদনে ব্যস্ত সময় পার করছে। শুঁটকি উত্পাদনের এই ভরা মৌসুমে কর্ণফুলীর চরে প্রতিদিন ২০ টনের বেশি শুঁটকি উত্পাদন হচ্ছে, যা চট্টগ্রাম নগরীর আছাদগঞ্জের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে সারাদেশে। প্রতিদিন কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলে জানিয়েছেন আছাদগঞ্জ শুঁটকিপট্টির ব্যবসায়ীরা।
কর্ণফুলী নদীর পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা চরাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ শুঁটকি ব্যবসায় জড়িত। কর্ণফুলী নদী পারের ইছানগর থেকে শুরু করে শিকলবাহা এলাকা পর্যন্ত শতাধিক চাঙ্গে শুঁটকি উত্পাদন হয়। এসব চাঙ্গে দেড় থেকে ২ হাজার শ্রমিক কাজ করে। এর মধ্যে প্রায় ৫শ’ নারীশ্রমিক রয়েছে। বর্তমানে শুঁটকি উত্পাদনের মৌসুম হওয়ায় শ্রমিকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।
জানা গেছে, দেশের মানুষের কাছে শুঁটকির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে শুঁটকি উত্পাদন দিন দিন বেড়েই চলছে চট্টগ্রামে। বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া ও টেকনাফ এলাকার গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ সংগ্রহ করে জেলেরা। দীর্ঘ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে এসব মাছ নিয়ে আসে কর্ণফুলীর চরাঞ্চল এলাকায়। এরপর চলে শুঁটকি উত্পাদনের প্রক্রিয়া। এ কাজটি তারা বছরের ৭ মাস ধরে করে বলে ওই এলাকার শ্রমিকরা জানায়। উত্পাদিত এসব শুঁটকি
প্রতিদিন ট্রলারে করে কর্ণফুলী নদী দিয়ে আছাদগঞ্জের শুঁটকিপট্টির আড়তে সরবরাহ করে ব্যবসায়ীরা। কর্ণফুলী চরাঞ্চলের উত্পাদিত শুঁটকি বেশ সুস্বাদু হওয়ায় সবার কাছে কদর বেশি বলে জানান স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয়রা জানায়, কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে চরাঞ্চলের মানুষগুলো এখন শুঁটকিকে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছে। দু’বছর আগেও শুধু ১৫-২০টি শুঁটকি উত্পাদনের চাঙ্গ থাকলেও বর্তমানে শতাধিক চাঙ্গ গড়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদীর চরাঞ্চলে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাঙ্গ রয়েছে কর্ণফুলীর নদীর পারে ইছানগর এলাকায়। এই এলাকায় শুঁটকি উত্পাদনের বৃহত্ ২০টি চাঙ্গ রয়েছে। এ ছাড়া আরও ১০-১৫টি অস্থায়ী ছোটখাটো চাঙ্গ গড়ে উঠেছে। শুঁটকি উত্পাদন সুবিধাজনক হওয়ায় মূলত এ সময়টিকে বেছে নেয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। তবে শীতকালে এ ব্যবসা আরও জমজমাট হয়।
কর্ণফুলীর চরাঞ্চল এলাকায় সরেজমিন জানা গেছে, শুঁটকি উত্পাদনের এখন ভরা মৌসুম। প্রতিদিন এ এলাকায় ১৫-২০ টন শুঁটকি উত্পাদন হয়। পাঁচ শতাধিক নারী শ্রমিকসহ প্রায় দুই হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক এখানে কাজ করে। এসব শ্রমিক রাত-দিন শ্রম দিয়ে শুঁটকি তৈরি করে। মহাজনরা (শুঁটকি চাঙ্গের মালিকরা) পুরুষ শ্রমিকদের ৪শ’ টাকা করে পারিশ্রমিক দেন। অন্যদিকে নারীদের ৩শ’ টাকা করে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় বলে নারী শ্রমিকরা জানান। এ ছাড়া আরও পাঁচ শতাধিক ভাসমান শ্রমিক রয়েছে। তারা মাছ কাটার কাজ করে। তারা বস্তাপ্রতি দাম নির্ধারণ করে পারিশ্রমিক নেয়।
এ সময় বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাগর থেকে মাছ ধরে আনার পর কাটার কাজ চলে। এরপর মাছগুলো চার-পাঁচ দিন রোদে শুকাতে হয়। এ কাজটি নারী শ্রমিকরাই করে। রোদে শুকানোর কাজ শেষ করে শুকনো মাছগুলোকে সারিবদ্ধ করে দ্বিতীয়বারের মতো রোদে শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়। এসব শুঁটকির শ্রেণিভেদ করে প্রতিকেজির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ১ নম্বরের প্রতিকেজি শুঁটকির দাম হাজার টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়াও ৪শ’ ও ৩শ’ টাকা পর্যন্ত মধ্যমমানের শুঁটকির দাম নির্ধারণ করা হয়। এর নিচে শ্রেণিভেদে ও শুঁটকির ধরন বুঝে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এ এলাকায় প্রায় ২০-৩০ জাতের শুঁটকি উত্পাদন হয়। এর মধ্যে সুরি, পাইশ্যা, লাক্ষ্যা, বাইল্যা, চাঁটা বাইল্যা, হাওর বাইল্যা, চল ফিশ, পাতা মাছ, মরিচ্যা, লইট্যা, মইল্যা, কেচকি, চিড়িং, টিক্কা, টাপ ফিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি উত্পাদন করা হয়।
এ বিষয়ে স্থানীয় জুলধা এলাকার বাসিন্দা রুবিনা আকতার নামে এক নারীশ্রমিক জানান, নারীরা পুরুষের সমান পরিশ্রম করলেও মহাজনরা পুরুষদের সমান বেতন দেয় না। বছরে ছয়-সাত মাস তারা শুঁটকি উত্পাদনের কাজ করেন। বছরের বাকি দিনগুলোতে খুব একটা কাজ জোটে না। তখন তাদের বেকার সময় কাটে।
এদিকে আনোয়ারা এলাকার বাসিন্দা ছমির মিয়া নামে এক শুঁটকি শ্রমিক জানায়, কর্ণফুলীর চরাঞ্চলে প্রায় ২ হাজার শুঁটকি শ্রমিক রয়েছে। তারা রাত-দিন পরিশ্রম করার পরও ন্যায্য পারিশ্রমিক পায় না। তারা রাত-দিন পরিশ্রম করার পরও মহাজনরা পারিশ্রমিক দিতে গড়িমসি করেন। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই করেন মহাজনরা।
এদিকে মহাজনরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। শাহ জামাল নামে এক মহাজন জানান, খরচের তুলনায় শুঁটকি ব্যবসায় তেমন লাভ নেই। এ ছাড়াও সারাবছর এই ব্যবসা করা যায় না। বছরে ছয়-সাত মাস শুঁটকি উত্পাদন করা যায়। বাকি সময় অলস বসে কাটাতে হয়। নারী শ্রমিকদের ভারি কাজ কম। তাদের দিয়ে শুকানোর কাজ করা হয়। পুরুষ শ্রমিকরা বোট (নৌকা) থেকে শুঁটকির বস্তা কূলে তুলে আবার এগুলো পানিতে পরিষ্কার করার কাজও করে। তাই তাদের বেতনও বেশি।