এক রসগোল্লা দুই কেজি

একে রসগোল্লা, তার ওপর ওজন দুই কেজি। রসে টইটম্বুর এই গোল্লা দেখলে যে কারো জিভে জল চলে আসবে। এই গোল্লার স্বাদ নিতে হলে আপনাকে আসতে হবে মেহেরপুর সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে।

এ গ্রামের বাজারে ‘মহিবুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। দুই কেজি ওজনের গোল্লা দেখে যদি লোভ সামলাতে না পারেন, আবার আকার দেখে ভয় পান, তবে ইচ্ছা করলে এক কেজি বা অর্ধ কেজি ওজনের একটা চেখে দেখতে পারেন।

এই বড় বড় রসগোল্লা গত চার বছর ধরে বানাচ্ছেন মহিবুল ইসলাম। প্রতিদিন জেলার দূরদূরান্ত থেকে লোকজন তাঁর দোকানে আসে। নতুন আত্মীয়রা তাঁর দোকান থেকে মিষ্টি কিনে স্বজনের বাড়ি যায়। এ দেখে এই বাজারে বড় বড় মিষ্টি তৈরির দোকান দিয়েছিল কয়েকজন। কিন্তু, বড় মিষ্টি ভালোভাবে বানাতে না পেরে দোকান বন্ধও করে দিয়েছে। জেলা শহরের অনেক নামিদামি মিষ্টি দোকানের কারিগররা তাঁর কাছে থেকে বড় গোল্লা তৈরির কৌশল শিখতে ছুটে যায়।

সম্প্রতি এক দুপুরে শ্যামপুরে বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দোকানপাট প্রায়ই বন্ধ। দু-একটি চায়ের দোকান খোলা আছে। এক চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলে মহিবুলের মিষ্টির দোকানটি দেখিয়ে দেন তিনি। মিষ্টির দোকানে গিয়ে দেখা যায়, আধা কেজি ওজনের বেশ কিছু রসগোল্লা দুটি পাত্রে রয়েছে। দুই কেজি ও এক কেজি ওজনের রসগোল্লা দুপুরের আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। বড় আকারের মিষ্টির চাহিদা বেশি থাকায় সেগুলো দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। দোকানে ঝোলানো মূল্যতালিকা দেখে জানা যায়, আধা কেজি ৯০ টাকা, এক কেজি ২০০ টাকা এবং দুই কেজি ওজনের একটি রসগোল্লার দাম ৫০০ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন দামে চমচম, রসমালাই, কালোজাম পাওয়া যায়।

দোকানে থাকতেই রেজানুল নামের এক ক্রেতা হাজির রসগোল্লা খাওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘এত বড় রসগোল্লা আর কোথাও পাওয়া যায় কি না আমি শুনিনি। মহিবুলের গোল্লার স্বাদ একবারে আলাদা। এ কারণে মাঝেমধ্যে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে এসে আগে নিজে খাই। ফিরে যাওয়ার সময় পরিবারের জন্য নিয়ে যাই। ’

মহিবুলের মতো আর কেউ এত ভালো রসগোল্লা বানাতে পারে না বলে দাবি করলেন ওই বাজারের চা বিক্রেতা মিনারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গোল্লা বড় হলে তার ভেতর দানা বা গুটি বেঁধে যায়। কিন্তু, মহিবুল দুই কেজি ওজনের গোল্লা বানালেও এর ভেতর কোনো গুটি বা দানা বাঁধে না। আল্লাহ তাঁর হাতে যেন জাদু দিয়েছেন। ’

মহিবুলের দোকান দেখাশোনা করেন তাঁর বাবা আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, চার বছর আগে চাষাবাদ করতাম। এ ছাড়া অন্য কোনো কাজ ছিল না। এখন চাষাবাদের পাশাপাশি ছেলের দোকানে বসেন। মেহেরপুরসহ আশপাশের জেলার লোকজন এখানে মিষ্টি খেতে আসে। আবার অনেকে কিনে নিয়ে যায়। প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ কেজি রসগোল্লা বিক্রি হয়। তিনি বলেন, ‘বংশের কেউ কখনো মিষ্টির কাজ করেননি। কিন্তু ছেলে নিজের চেষ্টায় বড় বড় রসগোল্লা বানানো শিখেছে। এটা বানাতে গিয়ে সে কত চিনি আর দুধের ছানা নষ্ট করেছে, এর হিসাব নেই। কিন্তু এখন তার কাছ থেকে শহরের অনেক মিষ্টি ব্যবসায়ী বড় গোল্লা বানানো শিখতে আসে। বাবা হিসেবে তাকে নিয়ে এখন আমার গর্ব হয়। ’

মহিবুল ইসলাম জানান, চার বছর আগে গ্রামের হাটে সবজি বিক্রি করতেন। প্রতিদিন সবজি বিক্রি শেষে রাতে গাংনীর একটি মিষ্টি কারখানায় যেতেন। কিভাবে মিষ্টি তৈরি করে তা মনোযোগ দিয়ে দেখতেন। দেখে দেখে মনে রাখতেন কোনটার পর কোনটা করতে হয়। ওখানে দেখতেন আর বাড়িতে এসে দুধের ছানা কিনে নিজে তৈরি করার চেষ্টা করতেন। এভাবে শিখতে গিয়ে প্রায় এক লাখ টাকা নষ্ট করেছেন। নষ্ট করতে করতে একটা সময় বড় গোল্লা তৈরি কৌশল রপ্ত করেন।

মহিবুল ইসলাম আরো বলেন, ‘এটা একান্ত নিজস্ব তাকের (ধারণা) ব্যাপার। আমি নষ্ট করতে করতে রপ্ত করেছি। ফলে এখন আর কোনো সমস্যা হয় না। একবারেই প্রাকৃতিক উপায়ে রসগোল্লা তৈরি করি। প্রথমে আধাঘণ্টা ধরে চিনি জ্বালিয়ে রস করি। দুধের ছানার সঙ্গে যৎসামান্য এলাচ গুঁড়ো এবং রুলি ময়দা ভালোভাবে মিশিয়ে গোল্লা রসের মধ্যে ছেড়ে দিই। এভাবে দেড় ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় রসগোল্লা। ’ তিনি জানান, তাঁর তৈরি বড় রসগোল্লা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পাঁচ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় অনেক দিন রাখা যায়। জাপান, আমেরিকা, সৌদি আরব, দুবাইসহ প্রায় ২০টি দেশের প্রবাসীরা এ রসগোল্লা কিনে নিয়ে গেছে।

মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, ‘মেহেরপুরের মিষ্টির ঐতিহ্য বহু পুরনো। এরই ধারবাহিকতায় নতুন একজন কারিগর বড় আকারের রসগোল্লা বানাচ্ছেন। এই মিষ্টি আমি খেয়েছি। আমার স্ত্রী তাঁর রসগোল্লার ভক্ত। ’

মেহেরপুর বিসিক শিল্প নগরীর জেলা ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘দুই কেজি ওজনের রসগোল্লা হয়, এটি প্রথম শুনলাম। একে ধরে রাখতে এবং বড় পরিসর দিতে বিসিকের পক্ষ থেকে ঋণ সহযোগিতা করা হবে। ’

মেহেরপুর সদর উপজেলার স্বাস্থ্য পরিদর্শক আনিসুর রহমান বলেন, ‘বড় ধরনের মিষ্টিতে দানা বেঁধে গেলে সেটা স্বাস্থ্যসম্মত না। শ্যামপুরের মহিবুলের মিষ্টি আমি খেয়েছি। এতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু নেই। ’