তরুণরাই আমাদের শক্তি

আমাদের দেশের যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণ সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। ব্রিটিশশক্তি যখন ভারতবর্ষকে চিরদাসত্বে পরিণত করার স্বপ্নে মশগুল ছিল, তখন তারুণ্যশক্তিই ব্রিটিশের অন্যায়-স্বপ্ন ও শক্তিকে চূর্ণবির্চর্ণ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানের ২৩ বছরের দুঃশাসনের চির অবসান ঘটিয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এ দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তরুণ সমাজ। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা কেড়ে নেয়ার গভীরতম ষড়যন্ত্র ও উদ্ধত উচ্চারণকে বুকের রক্ত দিয়ে রুখে দিয়েছিল আবুল বরকতেরা। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুল শক্তি তো তরুণেরাই ছিল। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-খেলাধূলা—অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে তারুণ্যের গৌরবময় ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের সত্যিকারের আলোর দিশারি এই তরুণ সমাজকেই আমরা এখনো বড় ভরসার জায়গা মনে করি।

পেশাগত কারণে প্রায় প্রতিদিনই খুব কাছ থেকে উজ্জ্বল তরুণদের দেখি, কথা বলি, সঙ্গে চলি। টগবগে এক একটি তরুণ বুকের গভীরে কী গভীর মমতায় লালন করেন মহান মুক্তিযুদ্ধকে—স্বাধীন বাংলাদেশকে! তাঁদের কণ্ঠে যখন জাতীয় সংগীত উচ্চারিত হয় তখন তাঁদের চোখে-মুখে যে আবেগ-দরদ-মমতা আর অহংকার দেখি—তা আমাদের বুকের ভেতর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো অবারিত এক শান্তির স্রোত বয়ে দেয়। হাছন-লালন-রবীন্দ্রনাথ তাঁদের মননে শক্ত শেকড় যেমন, তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকাটাও কেমন করে দারুণ গতিতে ঘুরিয়ে দেবে, বিশ্বকে দেখাবে উন্নতির তিলকপরা সফল ও সুখিসমৃদ্ধ এক নতুন বাংলাদেশ—সেই স্বপ্নচিন্তাও তাঁদের আঁকড়ে থাকে। এই তারুণ্যই তো আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে দেবে—বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়ে দেবে এই দেশকে— তরুণসমাজ তো সে পথেই এগুচ্ছে—বাংলাদেশও বিশ্বকে জানান দিচ্ছে তার সাফল্যতরীর অগ্রযাত্রার অপ্রতিরোধ্যতার কথা। বিশ্বও দেখছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষা-ক্রীড়া সকল ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যে মাথা উচু করে উঠে আসছে বাংলাদেশ নামক লাল-সবুজের একটি দেশ, যেখানে মূল শক্তি এদেশের তারুণ্য।

অনেকে বলছেন তরুণ সমাজ বখে যাচ্ছে—এলোমেলো চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে—গন্তব্যহীন তাদের অভিযাত্রা—মূল্যবোধের ঘাটতি ঘটছে। বায়ান্ন-একাত্তর-নব্বইয়ের চেতনার সেই অগ্নিস্পর্ধিত রূপ এখন আর নেই। ব্যক্তিস্বার্থ আর লোভের দেয়ালে বন্দি হয়ে এখনকার তরুণ সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। এসব কথা মেনে নেয়া অথবা এসবের সঙ্গে একমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। জমিতে যখন ফসলের চাষ করবেন, তখন কিছু আগাছা জন্মাবেই। সেগুলো নিয়মিত উপড়ে ফেলতে হয় এবং সঠিকভাবে জমির পরিচর্যা করতে হয় বীজ বপন থেকে ফসল ঘরে আসার আগ পর্যন্ত। যাতে ফসলের কোনো ক্ষতি না হয়। ফসলের উত্পাদন যাতে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের হয়। অনেক সময় দেখা যায় ঠিকঠাক মতো পরিচর্যা ও যত্ন নিলে ফসলের পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়কেও ছাড়িয়ে যায়। কৃষকের মুখে— কৃষকের ঘরে হাসি ফোটে। আর পরিচর্যা যদি ঠিকমতো না করা হয়—তাহলে আগাছা-আক্রান্ত হয়ে পড়ে ফসলি-জমি। ভালো ফসল পাবার আশা তখন দুরাশা হয়ে পড়ে।

আমাদের তরুণ সমাজের ভেতরও আগাছার মতো কিছু নষ্ট তরুণের জন্ম ঘটবে, ঘটছে, অতীতেও ঘটেছে। এদেরকে সম্পূর্ণভাবে হয়তো উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে না, কিন্তু নিয়মিত আগাছা পরিষ্কারের চর্চাটা আন্তরিকতার সঙ্গে সঠিকভাবে থাকলে, আড়ালে আবডালে ঘুবচি মেরে থাকা দুচারটে আগাছা তেমন ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে না। বর্তমানে দেশে শিশু-কিশোরী ও তরুণীদের ওপর যেভাবে নির্যাতন শুরু হয়েছে তা ভীষণভাবে উদ্বেগের বিষয়। তনু হত্যাকা্ল এখনো মানুষের চোখের জলে জেগে আছে। অনেক হত্যাকা্লের মতো তনু হত্যাকা্লও মানুষ একদিন ভুলে যাবে। শুধু ভুলতে পারবে না তাঁর মা-বাবা-ভাই পরিবারের আপনজনেরা। খাদিজাকে দিনদুপুরে ছাত্রলীগের বদরুল নামক এক নেতা কোপালো। কী ভয়ঙ্কর! যে দেশের মানুষের বুক ভরা থাকে মমতায়-ভালোবাসায়— সে দেশে বদরুলের মতো নির্মম পাষাণেরও জন্ম হয়। এদেশের তরুণ সমাজ বদরুলকে গ্রহণ করে না, সমর্থন করে না— তাকে ঘৃণা করে—তার উপযুক্ত বিচার দাবি করে— যারা দাবি করছে তারা কিন্তু তরুণ, যারা আমাদের অহঙ্কার ও গর্বের প্রতীক। ক্ষতবিক্ষত খাদিজাকে বুকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেছে যে ইমরানেরা, মানবতাকে বুকে ধারণ করে যে তরুণেরা তারাই আমাদের গর্ব ও ভরসার জায়গা। ইমরান কবির দেখিয়ে দিল তারুণ্য এখনো কী ভীষণভাবে অপ্রতিরোধ্য। আর বদরুল! চরমভাবে ঘৃণিত এক নাম। এ রকম বদরুলদের জন্য যেমন গোটা ছাত্রসমাজ কলঙ্কিত হতে পারে না, তেমনি সমালোচনার ঝড়ে ঢালাওভাবে তারুণ্যশক্তিকেও ছুড়ে ফেলা যায় না। বরং বদরুলের মতো যারা দলে আছে—তাদের উপড়ে ফেলা জরুরি।

লক্ষ্মীপুরের কলেজছাত্রী ফারহানা আক্তারও একই পরিস্থিতির শিকার। তাকে একজন চিকিত্সক ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের দিয়ে কুপিয়েছে বলে পত্রিকায় খবর হয়েছে। তিনিও একজন নেতা। জেলা বিএম’র সভাপতি। যদিও সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু এটি তো সত্য ফারহানাকে কোপানো হয়েছে এবং তিনি একজন ছাত্রী। এই ঘটনার মূল হোতাকে বের করা কি খুব কঠিন! হ্যা, কঠিনই তো। কঠিন না হলে তনু হত্যাকারীরা আজো আড়ালে কীভাবে থেকে যায়! এ রকম ঘটনা একটি দুটি নয়, অসংখ্য। অতীতেও এসব ঘটেছে। এখনো ঘটছে। বলেছি, আগাছা বেড়ে গেলে পুরো ক্ষেতের ফসলই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এর উদাহরণও অনেক আছে। আগাছা বেড়ে গেলে আবাদী জমিও অনাবাদী হয়ে যায়—এটি হিসেবে রাখতে হবে। কারণ বদরুল একা নয়, এ রকম আগাছা এর আগেও আমরা দেখেছি। গ্রাম-পাড়া-মহল্লা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এদের দাপট ভয়ঙ্কর। এসব মানুষহন্তারক আগাছা যেন ক্ষেতের স্বর্ণফসলকে গ্রাস না করে ফেলে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা খুবই দরকার। সারা দেশে ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর করে দেখাতে হবে। শুধু দেখানোর জন্যে বা কিছু একটা করার জন্যে করা— এতে খুব একটা সুফল আসবে না। যারা এসব জঘন্য কর্মকা্লে জড়িত, যারা মানবতাকে হত্যা করতে চায় তাদের খুঁজে বের করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটি দখল করতে হবে। অপরাধী যেই হোক তার বিচার হতে হবে— কিন্তু তাকে রক্ষাকল্পে আড়ালে আবডালে রেখে অপরাধ দমনের নামে বড় বড় বুলি আওড়িয়ে কাজের কাজ কিছু হবে না। বদরুলকে প্রথমে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ধরতে পারেনি, ভয় পেয়েছে। যদিও পরক্ষণেই সাধারণ মানুষ সে ভয়কে জয় করে তাকে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। তারুণ্যের শক্তি অপ্রিতিরোধ্য— তারা সত্য ও সুন্দরের প্রতীক—অসুন্দরের নয়। তারুণ্যের আলোতেই বিশ্ব দরবারে গৌরবে-অহংকারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ— সেদিন খুব বেশি দূরে নয়।

n লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,