হাজারীবাগের ট্যানারি পল্লী নিয়ে মহাপরিকল্পনা

রূপকল্প যাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে * গড়ে উঠবে আধুনিক আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবন
বদলে যাচ্ছে রাজধানীর হাজারীবাগের জীর্ণ চেহারা। ট্যানারি পল্লীর ৭০ বিঘা জায়গার ওপর পরিকল্পিত আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ শুরু করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের কাজ শেষ হওয়ার পর পরই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের টার্গেট রয়েছে সরকারের। আধুনিক সব সুবিধাই থাকবে এই জোনে।
সূত্র বলছে, আধুনিকতার দিক থেকে মতিঝিল, গুলশানসহ অন্য সব বাণিজ্যিক এলাকাকেও ছাড়িয়ে যাবে এটি। শিল্প মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য এ সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করছে, যাতে করে ট্যানারি স্থানান্তরের পরই সেখানে কাজ শুরু করা যায়। তবে এ অঞ্চলে অনেকের ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা রয়েছে। অনেক জায়গার ওপর বিপুল অংকের ব্যাংক ঋণ রয়েছে। সরকার যদি পুরো জায়গা অধিগ্রহণই করে তাহলে এগুলো কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
হাজারীবাগের ট্যানারি পল্লীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, পরিত্যক্ত ট্যানারি পল্লীর প্রতি ইঞ্চি জমি অর্থনৈতিকভাবে মূল্য সংযোজন ঘটানো হবে। এখানে শতভাগ সুবিধা সংবলিত সবচেয়ে পরিকল্পিত পরিবেশসম্মত আবাসিক ও বাণিজ্যিক জোন গড়ে তোলা হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় একটি রূপরেখা তৈরি করছে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য একটি প্রস্তাব পাঠানো হবে। তিনি সম্মতি দিলেই স্থানান্তর শেষ হওয়া মাত্র জমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ট্যানারির জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করবে, নাকি ব্যক্তি মালিকানার মাধ্যমে ছেড়ে দেবে, সেটি চূড়ান্ত হয়নি। অনুমোদনের পর শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন যৌথভাবে বসে তা ঠিক করার কথা রয়েছে।
সূত্র জানায়, ট্যানারিতে গড়ে তোলা বাণিজ্যিক ভবনের উপরের অংশে আবাসিক উপযোগী ফ্লোরও নির্মাণ করা হবে। এর বাইরে সম্পূর্ণ আবাসিকের জন্যও মাল্টি রেসিডেন্সিয়াল ভবন নির্মাণ করা হবে। ট্যানারি পল্লীর পুরো ‘লে আউট প্লান’ ধরে স্থানান্তর-পরবর্তী হাজারীবাগের খালি জায়গায় এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি পল্লী সাভারে স্থানান্তর হয়ে গেলে খালি জায়গা পরিকল্পিত ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হবে। বিশেষ করে এলাকাটির বিদ্যমান জরাজীর্ণ চেহারা পাল্টে দেয়া হবে। শতভাগ নাগরিক সুবিধা সংবলিত একটি আদর্শ আবাসিক পল্লী প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে পরিকল্পনা যাই থাকুক, এ ব্যাপারে আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে আলোচনায় বসেই ঠিক করব।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ট্যানারির ময়লা-আবর্জনাময় এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষায় জন্যই ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর হচ্ছে। পরিবেশ ব্যাহত হয় এমন কোনো কিছু আমরা চাই না আর। আশা করি, সরকার সেই রকম পদক্ষেপই নেবে। তারা বলছেন, ঢাকার জমি সোনার চেয়ে দামি। এ পরিস্থিতিতে ঢাকার বুকে যেখানে এক ইঞ্চি জায়গা বের করা কঠিন, সেখানে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় এত বিপুল পরিমাণ জমি খালি হওয়াটা অস্বাভাবিক একটি ঘটনা। সরকারের দৃঢ়তার কারণেই সেটি সম্ভব হতে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে এ বিপুল পরিমাণ জমির সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক মূল্য সংযোজনও নিশ্চিত করা উচিত।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন বলেন, এরই মধ্যে ট্যানারির পরিত্যক্ত জমির পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে একই সঙ্গে আবাসিক ও বাণিজ্যিক সুবিধার শতভাগ নিশ্চিত করতে বহুতলবিশিষ্ট মাল্টি কমার্শিয়াল ও মাল্টি রেসিডেন্সিয়াল ভবন নির্মাণ করা হবে এখানে। যেখানে একটি বহুতল ভবনের ১০ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হবে। বাকি তলাগুলো থাকবে আবাসিকের জন্য। কোনোভাবেই এ খালি জায়গায় নতুন করে অন্য কোনো শিল্প স্থাপন করতে দেয়া হবে না। একইভাবে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেও। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র এ সচিব আরও বলেন, আমরা এ ধরনের একটি প্রস্তাব খুব শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠাব।
হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ’৫০-এর দশকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে প্রথম ট্যানারি স্থাপনের মাধ্যমে চামড়া প্রক্রিয়াজাত শুরু হয়। পরে তা অনুকূল পরিবেশের কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে হাজারীবাগে ট্যানারি পল্লী করার অনুমোদন দেয়। একই সঙ্গে ট্যানারি গড়ে তোলার জন্য ৭০ বিঘা জমির ওপর ‘লে আউট প্লান’ চূড়ান্ত করা হয়। ১৯টি ট্যানারি শিল্পের মাধ্যমে তখন এ ট্যানারি পল্লীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এদের কোনোটির আয়তন ন্যূনতম ১০ কাঠা থেকে সর্বোচ্চ দুই বিঘা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখানে শিল্পের পরিমাণও বাড়ে। ছোট হয় ট্যানারি শিল্পের আকার। পাশাপাশি ট্যানারি পল্লীর নির্ধারিত জায়গা ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানার কিছু জমিতেও এ শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটে। এভাবে শিল্পটি ’৭০-র দশকে জাতীয়করণ হয়। ’৮০-র দশকে তা বেসরকারিকরণ করা হয়। ’৯০-র দশকে শিল্পটির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা, যা একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্পটিকেই স্থান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা এখন চলমান রয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন যুগান্তরকে বলেন, সরকারের পরিকল্পনা ভালো। ট্যানারি সম্পূর্ণ সরে যাওয়ার পর বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা এই হাজারীবাগের সবুজায়ন ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে একটি সুন্দর অঞ্চল গড়ে তোলা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে বেশ গলদঘর্ম হতে হবে। কারণ ট্যানারি শিল্পের মালিকদের অনেকেরই এখানে নিজস্ব জমি রয়েছে। এদের ৯০ ভাগই আবার ঋণের পরিবর্তে এ জমি ব্যাংকে বন্ধকী রেখেছে। বেড়েছে অংশীদারিত্বের সংখ্যাও। এ পরিস্থিতি সরকারের ঘোষণা ব্যক্তি পর্যায়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কেউ পারবে, কেউ পারবে না। বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে অমুকেরটা রেখে, তমুকেরটা কাজে লাগানো হলেও তা দিয়ে আধুনিক হাজারিবাগ গড়া সম্ভব হবে না। তিনি দাবি করেন, এ পরিকল্পনা সরকার কিসের ওপর ভিত্তি করে বাস্তবায়ন করবে, সেটি পরিষ্কার হওয়া উচিত। তবে সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে জমি অধিগ্রহণ করার। কিন্তু সেটি করতে হলেও ট্যানারি মালিকদের বিপুল ব্যাংক ঋণের দায় বহন করতে হবে সরকারকে।