ফুল বাণিজ্যে সফলতা

ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ছিল ফুলের মহাবাণিজ্য। সারাবছরই ফুল ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ টাকার ফুল সংগ্রহ করে থাকেন। বিশেষ দিন, জাতীয় দিবস, বিয়ে কিংবা জন্মদিন এসবের বাইরেও ফুলের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। তবে এই দুই দিনকে কেন্দ্র করে গোলাপ, জারবারা, রজনীগন্ধা, হলুদগাঁধা ও চন্দ্র মল্লিকা এসব ফুলের দাম ছিল আকাশচুম্বী। এই সময় পাইকারি বাজারে তিন টাকার ফুল বিশ টাকায় বিক্রি হয় এবং খুচরা বাজারে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট, আগারগাঁওসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বিশেষ দিনগুলোতে ফুলের বেচাকেনা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সারাদেশ থেকে ট্রাকে ট্রাকে ফুল আসে এসব এলাকায়। ফুল ব্যবসায়ীরা বলেছেন, প্রত্যেকবারের থেকে এবার তাদের ব্যবসা ভাল হয়েছে। কথা হলো শাহবাগের আনিসুল হক নামের এক ফুল ব্যবসায়ীর সঙ্গে। প্রতিদিন সে পাইকারি পাঁচ হাজার টাকার ফুল ক্রয় করে প্রায় বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। ফলে সে লাভ করছে পনেরো হাজার টাকা। তবে এবারের ফাল্গুন উপলক্ষ্যে লাভ অনেক বেশি হয়েছে। কেননা এবার ছিল না কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

শাহবাগের বটতলার ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘এবার মানুষের মধ্যে আনন্দ-উল্লাস একটু বেশি। দেশের সার্বিক পরিবেশও ভাল। রাজধানীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার শাহবাগে। এখানে রয়েছে ৫১টি পাইকারি এবং খুচরা ১০০টি ফুলের দোকান। এবার শুধু শাহবাগেই কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে, যা গতবাবের চেয়ে বেশি।’ রাজধানীজুড়ে হাজারের বেশি ফুল ব্যবসায়ী রয়েছেন। সারাদেশের খুচরা ফুল বিক্রেতারা শাহবাগ, ফার্মগেট ও আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ফুলের পাইকারি মার্কেটে আসেন। রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ফুল বেচাকেনা হয়। আর বিশেষ দিনগুলোতে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। তবে দেশব্যাপী সমিতির অধীনে রয়েছে আরও ছয় হাজার ফুলের দোকান। সব মিলিয়ে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হয়।

বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে যশোরের ঝিকরগাছায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু হয়েছিল। তবে ক্রমেই এটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। যাদের উপর নির্ভর করছে প্রায় সাত লাখ মানুষের জীবনযাপন।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ফুল উৎপাদিত হচ্ছে যশোরের ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার ছয়টি ইউনিয়নের নব্বইটি গ্রামে। এখানে চার হাজার বিঘা জমিতে ফুল চাষ করে স্থানীয় কৃষকরা। মাঠের পর মাঠ জুড়ে ফুলের ক্ষেত। ফুল এখানে ফসল। এসব ক্ষেত থেকে প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ফুল উৎপন্ন হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাণিজ্যিকভাবে যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহসহ ২৪টি জেলায় প্রায় ১০ সহস্রধিক হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে।

দেশে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ফুল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার টন। প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার টন। প্রতিবছরই এভাবে ফুল চাষের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন উভয়ই বাড়ছে। ফুল ব্যবসায়ী ও চাষীরা অগ্রসরমান এ খাতকে এগিয়ে নিতে সমন্বিত ফুল নীতি, ফুলের স্থায়ী বাজার এবং ফুল নিয়ে গবেষণার দাবি জানিয়েছেন। ফুল গবেষণাকেন্দ্র স্থাপিত হলে টিস্যু কালচার, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার বিষয়গুলো নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশ ফুল উৎপাদন ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতি এম আহসানউল্লাহ বলেছেন, ফুল রফতানি করার জন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে ফুল উৎপাদনের জায়গা হলে ভাল হবে। যশোরের ঝিকরগাছা ও সাভারে ফুল গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাবও তিনি দিয়েছেন। রফতানি প্রতিবন্ধকতাই এই খাতের প্রধান সমস্যা। এই সমস্যা দূরীকরণে ফুলচাষী কল্যাণ সমিতি ও ফ্লাওয়ার সোসাইটির নেতৃবৃন্দ বহু প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তবে এখনও প্রতিবন্ধকতা দূর হয়নি। ফুল রফতানির সরকারী নীতিমালার অভাবে ফুল সবজি হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে। ফুলের সঙ্গে পানও সংযুক্ত করে রফতানি করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ফুলের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে এই সুযোগকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সরকারী নীতিমালার মাধ্যমে ফুল রফতানির প্রতিবন্ধকতা দূর হলে ফুল উৎপাদন হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় খাত।