মুক্তিযোদ্ধাদের সুদমুক্ত গৃহঋণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সংবলিত একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপককে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের
কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার বিষয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ ফজলুল হকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সভায় বলা হয়, যাচাই-বাছাইসহ বিভিন্ন কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা পরিবর্তন হচ্ছে। তাই ঋণ গ্রহণের জন্য কতজন উপযুক্ত বিবেচিত হবেন বা কতজন মুক্তিযোদ্ধা ইচ্ছুক হবেন, তা নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া তাদের ঋণ দিতে মোট কত টাকা প্রয়োজন হবে, তাও বছরভিত্তিক নির্ধারণ করতে হবে। এজন্য তথ্যাদি সংগ্রহপূর্বক একটি নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবু ফরাহ মোঃ নাছেরকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। সদস্য সচিব করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের উপপরিচালক মোঃ ইকবাল হোসেনকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সরকারি মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট উপমহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের একজন করে প্রতিনিধি।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মার্চে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বিনা সুদে ঋণ দেয়ার সরকারের পরিকল্পনার কথা জানান। এরপর একজন মুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা সুদে গৃহঋণ দেয়ার অনুরোধ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া যায় কিনা, তা জানতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মন্তব্য চান অর্থমন্ত্রী। পরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিবাচক মতামত দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা সরকার থেকে যে ভাতা পান, সেই ভাতার বিপরীতে অর্থাৎ ভাতা থেকে ঋণ সমন্বয়ের শর্তে এ প্রকল্প চালু করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিনা সুদে ঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের বিস্তারিত কর্মকৌশল কি হবে, এতে সম্ভাব্য আর্থিক সংশ্লেষণের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত ও মতামত সংবলিত বিস্তারিত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তুত করেছে। এতে দুইটি বিকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথম প্রস্তাবে মুক্তিযোদ্ধারে বিনা সুদে আনুমানিক ১৫ হাজার ৩ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকার বাজেট থেকে সংস্থান করতে পারে। বিকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো নিজস্ব তহবিল থেকে এ অর্থ সংস্থান করবে। উভয় প্রস্তাবে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে ৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ঋণের মেয়াদ হবে ১০ বছর। ঋণগ্রহীতা মুক্তিযোদ্ধাকে ১২০টি কিস্তিতে ঋণের মূল টাকা পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে আসল টাকা পরিশোধে মাসিক কিস্তির পরিমাণ হবে ৬ হাজার ৭৯২ টাকা। এ ঋণের জন্য কোনো সুদ দিতে হবে না। ঋণগ্রহীতার পক্ষে যাবতীয় সুদ সরকার দেবে।
সভায় আরও বলা হয়, সরকার বর্তমানে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা দিয়ে থাকে। তাই বর্ধিত এ ঋণ সুবিধা এসব ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়ার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সভায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ ফজলুল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সুদমুক্ত ঋণ দিতে যে ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে, সেটা সরকারের বাজেট থেকে সংস্থান করা দুঃসাধ্য হবে। তবে সরকারকে একবারই এ অর্থ দিতে হবে না বলে প্রতীয়মান হয়। তাই ঋণ বিতরণের সম্ভাব্য আবেদনের সংখ্যার ভিত্তিতে এর পরিমাণ নির্ধারণ করা যুক্তিযুক্ত হবে।
সভায় সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিনিধিরা জানান, বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ২ লাখ টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা করে গৃহ নির্মাণ ঋণের সুবিধা চালু রয়েছে। ব্যাংকের তহবিল থেকে ৮ লাখ টাকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ দিতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক সামর্থ্য ও তার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে মতামত চাওয়ার পরই বাংলাদেশ ব্যাংক মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা সুদে বাড়ি বানানোর ঋণ ব্যবস্থা চালু করার জন্য একটি পর্যালোচনা বৈঠক করে। বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়ি বানানোর প্রকল্পটিকে আদর্শ হিসেবে নেয়া হয়। ওই প্রকল্পে ২ হাজার ৯৭১ মুক্তিযোদ্ধার জন্য বাড়ি বানানোর কার্যক্রম চলছে। প্রকল্পের একটি বাড়িতে রয়েছে দুইটি বেডরুম ও বারান্দাসহ একতলা বাড়ি, আলাদা বাথরুম, টিউবওয়েল এবং গরু ও হাঁস-মুরগি পালনের শেড। এরকম একটি বাড়ি বানাতে ওই প্রকল্পে বাড়িপ্রতি ৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ অর্থের সঙ্গে ভবিষ্যৎ বর্তমান বাজারদর বিবেচনায় নিয়ে প্রতি ইউনিট গৃহ নির্মাণে ৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা খরচ হবে বলে প্রাক্কলন করেছে।
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলায় সম্মানী ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৭৬ হাজার ২০৭ জন। এর বাইরে ভাতাপ্রাপ্ত ৭ হাজার ৮৩৮ যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং ৪১ নারী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৬ মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যেককে পাকা বাড়ি নির্মাণের জন্য ৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হলে ১৫ হাজার ৩ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্কলনে বলা হয়েছে।