
জানা যায়, ভিক্ষু মনীষা ধর্মাধিপতি সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরর উদ্যোগে ১৯৬০ সালে এ বৌদ্ধ বিহারের যাত্রা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক ও দেশের সরকারপর্যায়ে অনেক চেষ্টার ফলে অবশেষে সরকার ১৯৬০ সালের ৩ জুলাই রেজিস্ট্রি করে কমলাপুরে বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের নামে সাড়ে ৪ একর জমি প্রদান করেন। বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি হিসেবে মহাথেরর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার। ধীরে ধীরে এ বিহার বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ধর্মচর্চা, প্রগতি ও জাগৃতির অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত হয়। পরে ১৯৬২ সালে ২ মার্চ এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের রাজা ভুমিবল সস্ত্রীক এ ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের উদ্বোধন করেন। আর তাদের আগমনে বিহারে নির্মাণ করা হয়েছিল অতীশ দীপঙ্কর নামে একটি প্রার্থনা হল। তারপর থেকেই বিশ্বের নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের আগমনে এ বিহারের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ধর্মরাজিক বিহারের প্রতিষ্ঠালগ্নেই এখানে বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক গড়ে উঠেছে ধর্মরাজিক পালি কলেজ। দেশ স্বাধীনের পরে এটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ এখানে গড়ে তোলে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আর স্বাধীনতা যুদ্ধে আহত ও হতদরিদ্র ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব অসহায় শিশুর জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ধর্মরাজিক অনাথালয়। এখানে বর্তমানে ৫৪৬ জন অনাথ বসবাস করছেন। এ বিহারে ৫২ জন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রমন (ভিক্ষু শিক্ষার্থী) রয়েছে বলে জানিয়েছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু করুনানন্দ তের।
তিনি আরও জানান, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ধর্মরাজিক উচ্চবিদ্যালয়। কচিকাঁচাদের জন্য ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মরাজিক কিন্ডারগার্টেন। দুই বছর পরেই হয় ধর্মরাজিক ললিতকলা একাডেমি, ধর্মরাজিক সাহিত্য আসর, সবার চিকিৎসা সেবার জন্য ১৯৯৬ সালে গড়ে তোলা হয় ধর্মরাজিক নিক্কিউনিয়ানো ক্লিনিকও গড়ে তোলা হয়। ওই বছরই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মরাজিক আন্তর্জাতিক উপাসনা হল। হলটি ২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের প্রখ্যাত সাধক ফরা সোমদেত মহারাজা মঙ্গলচারিয়ার নামে উৎসর্গ করা হয়। উপাসনা হলে এদেশের সর্বস্তরের বৌদ্ধ সম্প্রদায়সহ রাজধানীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সব ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, মহাবিহারর মূল মন্দিরে প্রতœতাত্ত্বিক বিচারে অমূল্য সম্পদসম অতি প্রাচীন ও মূল্যবান কয়েকটি বিরল বুদ্ধমূর্তি রয়েছে।
এই মহাবিহার কমপ্লেক্সে মহান বাঙালি বৌদ্ধ ভিক্ষু অতীশ দীপংকর শৃঙ্গানের চিতাভস্ম সংরক্ষিত আছে। ১৯৭৮ সালে চীন থেকে এ ভস্ম মহাবিহার এখানে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া এখানে বাংলাদেশ-জাপান মৈত্রী সমিতির প্রথম সভাপতি, বাংলাদেশের পরম হিতৈশী বন্ধু হায়াকা ওয়ার দেহভস্ম ও নানা স্মৃতিচিহ্ন রক্ষিত আছে। বিহার চত্বরে ’৬০-এর দশকে শ্রীলংকা থেকে এনে রোপণ করা হয় বোধিবৃক্ষের চারা। এটি এখন বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং পিডব্লিউডির বাস্তবায়নে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে এখানে নির্মাণ করা হচ্ছে ধর্মরাজিক অডিটরিয়াম।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেভপ্রিয় বড়–য়া যুগান্তরকে বলেন, ভিক্ষুমনীষা ধর্মাধিপতি সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের মনে করেন বিশ্বের কাছে এ বৌদ্ধ মহাবিহার ধর্ম ভেদাভেদ নয় বরং মানবসেবা ও প্রেমের এক অনন্য উদাহরণ। মানবকল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেবামূলক এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আজ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নানা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। যাদের দেখলে মনে আসে প্রশান্তি। তিনি তখন নিজেকে মনে করেন স্বার্থক। এ মহাবিহারের সব মহতী কর্মযজ্ঞের ধারাবাহিকতা যেন যুগ যুগান্তরে বজায় থাকে এমনটিই প্রত্যাশা বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘসহ দেশ-বিদেশের সব বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের।