শিক্ষাক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক কিছু দিক

দেশে বর্তমানে ৩১ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। ৩৮টি পাবলিক ও ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দেশে। ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আগে একমাত্র ভারতেই ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য যেত, ফলে দেশ হারাত এক বিশাল অঙ্কের দেশি মুদ্রা।
এখন এ সংখ্যা শূন্যের কোটায় 

শিক্ষাক্ষেত্রে ভালোমন্দ যা কিছুই ঘটে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা তা নিয়ে কথা বলেন, আলোচনা করেন ও লেখেন। এগুলো স্রেফ সমালোচনা নয়, বরং সরকারের জন্য এক ধরনের পজিটিভ ফিডব্যাক। সরকারে যারা থাকেন, যত গণতন্ত্রই থাকুক না কেন, তারা মাঠের আসল খবর সবসময় পান না, কারণ চাটুকারের দল তাদের সর্বদাই ঘিরে রাখে। আবার রাজনীতিতে সত্যিকারের বিরোধী দলও নেই যে, তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সরকারের ত্রুটি বের করবে আর সরকার সাবধান হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তাই মিডিয়া ও বিভিন্ন পেশাজীবী যা বলেন, তার মধ্যে সরকারকে মেসেজ খুঁজতে হবে। আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি, লেখালেখি করি, তারা শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোর আলোচনা, সমালোচনা, প্রশংসাÑ যেটির ক্ষেত্রে যা প্রাপ্য, তাই করে থাকি। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে এমন কিছু পদক্ষেপ থাকে যেগুলো প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
এটি একটি আনন্দের সংবাদ যে, এবারই (২০১৭ সালে) প্রথমবার পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৪ হাজার ৬৬১ শিশুকে বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে ৫১ হাজার ৭৮২টি বই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা প্রথম স্কুলে গিয়ে বাংলা ভাষা ঠিকমতো বোঝে না। তাই অনেকেই পড়ালেখা ঠিকমতো করে না। এজন্য চাকমা, মারমা, সাদ্রী, গারো ও ত্রিপুরাÑ এ পাঁচ ভাষায় শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তরে তাদের মাতৃভাষায় বই দেয়া হচ্ছে। এবারই প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বইও ছাপানো হয়েছে। ১ হাজার ২৩১ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে দেয়া হয়েছে ৯ হাজার ৭০৩টি ব্রেইল বই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। এ ব্যাপারে জরিপ চলছে, আগামীতে সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীই ব্রেইল বই পাবে। পাঠদানের সুবিধার্থে এবার শিক্ষকদের জন্য ১ কোটি ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৭৬৮টি ‘শিক্ষক নির্দেশিকা’ বিতরণ করা হচ্ছে। কীভাবে পড়াতে হবে, সে বিষয়ে শিক্ষকদের জন্য নির্দেশিকা আছে তাতে।
২০১৭ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয় ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই। সরকারের ঢালাওভাবে সবার জন্য বিনামূল্যে বই আমার কাছে খুব সমর্থনীয় বা প্রশংসনীয় বিষয় নয়, তবে এ বিষয়টিকে প্রশংসা না করে পারছি না যে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিনামূল্যে ব্রেইল বই বিতরণ করা হচ্ছে। ধনী-দরিদ্র, শহর-গ্রাম সবার জন্য বিনামূল্যে বই বিতরণ করতে গিয়ে প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা করতে গিয়ে অনেক ভুলভ্রান্তি তো আছেই, মানের দিকে কেউই খেয়াল রাখতে পারছেন না। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থী, বস্তিবাসীদের জন্য বিনামূল্যে বই এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বিনামূল্যে বই, উন্নতমানের শিখন সামগ্রী বিতরণে জোর দেয়া উচিত। সরকার এ কাজটি এবার শুরু করায় ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। আর একটি প্রশংসনীয় কাজ হচ্ছে শিক্ষকদের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা বিতরণ। নতুন নতুন অনেক শিক্ষক যোগদান করছেন শিক্ষকতা পেশায়, যাদের অভিজ্ঞতা নেই, নতুন ধরনের বইপুস্তকের সঙ্গে পরিচিতি নেই। এসব শিক্ষকের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ।
২০১৫ সাল থেকে প্রাথমিকের সব শিশুই এসেছে উপবৃত্তির আওতায়। আগে ৭৮ লাখ শিশু ছিল উপবৃত্তির আওতায়, এখন ১ কোটি ৩০ লাখ। তাদের প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। তবে আগের মতোই সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার স্কুলগুলো উপবৃত্তির বাইরে রাখা হয়েছে। শিশুদের প্রতি মাসে উপবৃত্তি দেয়া হলে এ টাকা দিয়ে তারা খাতা-কলম কিনতে পারবে। লেখাপড়ার জন্য অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অভিভাবকরা যখন দেখবেন, তাদের সন্তানদের পড়াতে কোনো খরচই হচ্ছে না, তখন অসচ্ছল অভিভাবকরাও তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন। কাজেই সরকারের এটি একটি চমৎকার পদক্ষেপ। বাচ্চাদের উপবৃত্তির টাকা অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে দেয়া হবে বলে জানা যায়। এটি আর একটি ভালো দিক। রূপালী ব্যাংকের শিউর ক্যাশের মাধ্যমে এ উপবৃত্তির টাকা দেয়া হবে।
১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ৮৪৩টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন বঙ্গবন্ধু। এরশাদ ও বিএনপি সরকারের আমলে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক, কারণ এরশাদ সরকার কিংবা বিএনপি সরকার, যারাই সরকারে থাকুক না কেন, তারা সবাই বাংলাদেশের মানুষ। কীভাবে তারা বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব না দিয়ে পেরেছেন, তা বুঝতে কষ্ট হয়। ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। তবে সরকার এমন গ্রামে স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, যে গ্রামের লোকসংখ্যা কমপক্ষে ২ হাজার ও ২ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্কুল নেই। সে হিসাবে ১ হাজার ৫০০ গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ। এরই মধ্যে ১ হাজার ২০০ বিদ্যালয়ের কাজ শতভাগ এবং ৩০০ স্কুলের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণ করা হয়, এটিও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। বিদ্যালয়হীন ১ হাজার ৫০০ গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজও প্রায় শেষের দিকে। বেশিরভাগ স্কুলেই ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে শ্রেণী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে বিদ্যালয়হীন গ্রামের শিশুরা সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায়। প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদাও বাড়ানো হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলও এক ধাপ উন্নীত করা হয়েছে। আবার একই সঙ্গে এটিও দেখতে হবে যে, বেসরকারি হিসাবে ৯৭ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, সরকার যদিও দাবি করে এ হার শতভাগ। তবে যে শিশু ভর্তি হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রায় ২১ শতাংশই পঞ্চম শ্রেণী শেষ না করেই ঝরে যায়। সব মিলিয়ে ২৪ শতাংশ শিশু প্রাথমিকের গ-ি পার হতে পারছে না। এ বিষয়টিতে এখন নজর দিতে হবে।
আর শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা ও দক্ষতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। ২ ঘণ্টা বা ৩ ঘণ্টার প্রান্তিক পরীক্ষা অনেকটাই লটারির মতো। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ‘শিখন দুর্বলতা’ ঠিকমতো প্রকাশ পায় না এ ধরনের মূল্যায়নের মাধ্যমে। কাজেই কোনো প্রান্তিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়নে খুব একটা সহায়ক ভূমিকা রাখে না, বরং রেগুলার শ্রেণী পাঠ এতে বিঘিœত হয়, শিশুরা অপ্রয়োজনীয় চাপে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানার্জনের চেয়ে পাস করানোর চিন্তা, উচ্চগ্রেড পাওয়ার চিন্তা সৃষ্টি হয় আর তার সঙ্গে আসে কোচিং, স্পেশাল ক্লাস, প্রাইভেট পড়ানো ইত্যাদি। যে কোনো বিষয় যেমন ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিতÑ এর বাহন হচ্ছে ভাষা। দুইটি ভাষাই সেখানে জরুরিÑ বাংলা ও ইংরেজি। আমরা যে কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, বোঝার চেষ্টা করা বা বোঝানোর চেষ্টা করা সবক্ষেত্রেই কিন্তু ব্যবহার করছি ভাষা। এই ব্যবহৃত ভাষা যত প্রাঞ্জল হবে, কোনো বিষয় বুঝতে এবং বোঝাতে তত সহজ হবে। কাজেই আমাদের শিক্ষার্থীদের এ ভাষাজ্ঞান, ভাষা ব্যবহারের দক্ষতার ওপর প্রথম থেকেই জোর দেয়া উচিত।
এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৭ লাখ। তার মধ্যে ৪ কোটি বেকার। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স’ ইউনিটের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। একটি সমাজের বড় সম্পদ তার তরুণ সম্প্রদায়। সেই তরুণ সম্প্রদায়ই যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে সমাজের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব হবে, বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। জাতিসংঘের ২০৩০ সালের মধ্যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস নামক পরিকল্পনার ১৭টি গোল বা লক্ষ্য অর্জনের মিছিলে অমরা শরিক হতে পারব কিনা, তাও ভেবে দেখতে হবে। আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্মকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। বাংলাদেশে বেকারদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি। কারণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারা। বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতেই কর্মসংস্থান বেশি সৃষ্টি হওয়ার কথা। বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত মানবসম্পদ। মানবসম্পদ সৃষ্টি হয় শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। বছরভিত্তিক অর্থনীতির সূত্রে কোনো এক বছর ৩২ লাখ ৪৩ হাজারের অধিক ছেলেমেয়ে কর্মজগতে প্রবেশ করবে। উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজ যদি তাদের মানবসম্পদে রূপান্তর করতে না পারে, তাহলে সমাজে তার প্রভাব পড়বে।
দেশে বর্তমানে ৩১ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। ৩৮টি পাবলিক ও ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দেশে। ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আগে একমাত্র ভারতেই ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য যেত, ফলে দেশ হারাত এক বিশাল অঙ্কের দেশি মুদ্রা। এখন এ সংখ্যা শূন্যের কোটায়। এখন যেটি প্রয়োজন, তা হচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের দিকে জোর দেয়া, যাতে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পাশাপাশি সৎ, যোগ্য ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসতে পারে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। আমরা এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ থেকে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে অনেকেই আসবে। সরকারকে আর একটি বিষয়ে কঠোর হতে হবে, সেটি হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির নামে যা হচ্ছে, তা কঠোর হস্তে দমন করা। এখন কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্যকোনো দলের অস্তিত্ব সেভাবে নেই, কাজেই কারা কী করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তার নিরপেক্ষ হিসাব সরকারকে রাখতে হবে, যাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারি।