হারিয়ে যেতে বসেছে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? দুঃখজনক হলেও দেশের বর্তমান হালচাল যা তাতে করে এই নিষ্ঠুর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ যাবত্কাল পর্যন্ত জাতি হিসেবে গৌরব করার মতো আমাদের যত কিছু আছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের বিজয়ের গৌরবগাথা। একাত্তর আমাদেরকে বিজয় দিয়েছে। গৌরব দিয়েছে। সেই বিজয়-গৌরব ম্লান হবার নয়। কিন্তু সাড়ে চার দশকের মাথায় এসে জাতি আজ যে কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হলো, সেই গৌরবের মর্যাদা কি জাতি ধরে রাখতে পেরেছে? অমূল্য বিজয়ের সেই ফসল কি দেশবাসীর ঘরে ঘরে তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, না!
এই না পারার মধ্যেই রয়েছে পরাজয়ের গ্লানি, হতাশার দুঃখবোধ। একাত্তরের অর্জিত বিজয়সম্ভারকে আরো সমৃদ্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারাকে দৃঢ়মূল করা ইত্যাদি কর্তব্য সম্পাদন তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও সাফল্যগুলোকে পরিপূর্ণভাবে ধরে রাখাটাও সম্ভব হয়নি। আরো এগিয়ে যেতে না পারাটি নিঃসন্দেহে একটি বেদনাবহ ঘটনা। কিন্তু কিছু একটা অর্জনের পরেও তা ধরে রাখতে না পারার গ্লানি ও যন্ত্রণা হলো অপরিসীম। জাতির জন্য এটি একটি কলঙ্ক।
একাত্তরের বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতিকে প্রগতির পথে বিকশিত হওয়ার অমূল্য সুযোগ এনে দিয়েছিল। বিজাতীয় শক্তির ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে যে স্বাধীন রাষ্ট্র আমরা সেদিন প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেই রাষ্ট্রে সাম্য, মৈত্রী, শোষণমুক্তি, শান্তি, স্বাধীনতা ও প্রগতির পথে নবজীবনের সূচনা করার পথ তৈরি হয়েছিল। বহুদিন ধরে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতির গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃজিত চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মরণপণ প্রত্যয় ও দেশবাসীর সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরা আমাদের দেশের সংবিধান রচনা করেছিলাম। বাহাত্তরে রচিত সেই সংবিধানে ভাষা ও রূপ পেয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা ও ধারা। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা— এই চার নীতিকে ঘোষণা করা হয়েছিল রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে।
আত্মশক্তির উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন জাতীয় বিকাশের ধারায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘জাতীয়তাবাদ’কে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই জাতীয়তাবাদের ছিল গভীর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী উপাদান। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে লড়তে হয়েছিল পাকিস্তানের হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে। আর সেই পাকিস্তান ছিল আমেরিকাসহ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী একটি রাষ্ট্র। ব্রিটিশশাসিত ভারতে ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ ছিল সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রমূলক খেলার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। সাম্রাজ্যবাদ তার ‘ভাগ কর-শাসন কর’ নীতি প্রয়োগ করে, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে, ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে, প্রতিক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি সম্ভব করে তুলেছিল। রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-সামরিক আধিপত্যবাদী স্ট্র্যাটেজির একটি প্রধান হাতিয়ার। সিয়াটো, সেন্টো ও বিভিন্ন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বদৌলতে পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল বিশ্বের এই অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি সামরিক ও রাজনৈতিক ‘আউটপোস্ট’।
বহুদিন ধরে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মহলের অনেকে এমন একটি ভ্রান্তি ও মোহে আচ্ছন্ন ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর কাছে তদবির ও দেন-দরবার করে বাঙালির স্বাধিকার আদায় করে নেয়া যাবে। যেভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের তোয়াজ করে ও তাদের ষড়যন্ত্রের সহযোগী হয়ে ভারত ভেঙে আদায় করা সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু দেন-দরবারে কাজ হয়নি। স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল। পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল। একাত্তরের সংগ্রাম এভাবে পরিণত হয়েছিল বাঙালি জাতির সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়-মুক্তির সংগ্রামে। কিন্তু শাসকদল ছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ধারায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল ও দোদুল্যমান চরিত্রের। আর, পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে মুক্তিযুদ্ধের সেই নীতি ও পথ সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে উল্টোপথে যাত্রা শুরু করা হয়েছিল। দেশকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের সঙ্গে বেঁধে ফেলে এদেশকে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারার পরিপন্থি সেই ভ্রান্ত পথ ধরেই আজও দেশ অগ্রসর হচ্ছে। সাড়ে চার দশকের বুর্জোয়া শাসনে ‘জাতীয়তাবাদ’ এখন পরিণত হয়েছে ‘আত্মসমর্পণবাদে’।
পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী—একনায়কত্ববাদী ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি রাষ্ট্র। ভাষার অধিকার, সার্বজনীন ভোটাধিকার, নির্বাচিত সরকার দ্বারা দেশ পরিচালনা করার অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মৌলিক নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের গ্যারান্টি— পাকিস্তানে এসব ছিল নির্বাসিত। সত্তরের নির্বাচনের গণরায়কে কার্যকর হতে যখন বাধা দেয়া হলো, তখনই গর্জে উঠেছিল বাংলাদেশ। নির্বাচনের গণরায় বাস্তবায়নের প্রয়োজনেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ। মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের অলঙ্ঘনীয় নিশ্চয়তা, আইনের শাসন, নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা, পূর্ণ কর্তৃত্ববান নির্বাচিত স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, ভূমি সংস্কার, সকল নাগরিকের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিত্সা-বাসস্থানের নিশ্চয়তা, বৈষম্যের অবসান ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত গণতন্ত্রায়নের পথে সুনির্দিষ্ট নীতি ও পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সংবিধানে। সেসব ব্যবস্থার আলোকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি রূপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ‘গণতন্ত্র’। কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় করার প্রয়াসে শুরু থেকেই ছিল দুর্বলতা। আর পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটানোর পর কয়েক দফায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল সরাসরি কিংবা বেসামরিক লেবাসে সামরিক বাহিনীর শাসন-কর্তৃত্ব। বছরের পর বছর ধরে লালিত হয়েছিল স্বৈরাচারের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি। নব্বইতে রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরশাসন উচ্ছেদ করে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ধারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও গণতন্ত্র নিরঙ্কুশ করা সম্ভব হয়নি। স্বৈরাচারের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তির মূল উপাদানগুলো এখনো বহাল রাখা হয়েছে। চলছে লুটপাটের অর্থনীতি, লুটের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সংঘাত, অপরাধমূলক কুিসত সব অপ-রাজনীতির খেলা, রাজনীতিতে বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়ন, নির্বাচনে নমিনেশন বাণিজ্য-টাকার খেলা-ক্যাডার লালন ইত্যাদির রোগাক্রান্ত দাপট। চলছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্য। চলছে বিদেশি শক্তির নাক গলানো ও নিয়ন্ত্রণ। বাণিজ্যিকীকরণ, দুর্বৃত্তায়ন ও ভোগবাদ ইত্যাদি সবকিছুকে গ্রাস করে চলেছে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে রুগ্ণতা। রাষ্ট্র পরিচালনা কাজের ভিত্তিমূলে বিরাজ করছে অদৃশ্য নৈরাজ্য। ‘অস্থিতিশীলতা’ই এখনো হয়ে রয়েছে জাতীয় জীবনের সবচেয়ে স্থিতিশীল বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ বুর্জোয়া শাসনের ফলে ‘গণতন্ত্র’ আজ কার্যত হাতছাড়া!
পাকিস্তানি আমল থেকেই দেশবাসীকে সংগ্রাম করতে হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভট পাকিস্তানি মতাদর্শের বিরুদ্ধে। বাঙালি জাতির নিজস্ব জাতীয় আত্মপরিচয়ের উপলব্ধি ও জাতিগত জাগরণের মধ্য দিয়ে জনগণের মাঝে এই উপলব্ধি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ধর্ম আলাদা-আলাদা হলেও জাতি হিসেবে পরিচয় সকলেরই এক এবং তা হলো বাঙালি। ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিক অধিকারকে বিভাজিত করার কোনো সুযোগ তাই আর থাকতে পারে না। এমনকি এদেশে বসবাসকারী অপরাপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষও বাঙালিদের মতো সমান অধিকারসম্পন্ন। হিন্দু-মুসলমান, আমির-ফকির, বাঙালি-আদিবাসী নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সামনে সব নাগরিকই সমান অধিকার ও মর্যাদাসম্পন্ন। রাষ্ট্রনীতিতে এটিই ধর্মনিরপেক্ষতা বলে পরিচিত। পাকিস্তানের মতো ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক ভেদনীতিকে ভিত্তি করে এক ‘নব্য বাংলাস্থান’ সৃষ্টির জন্য শহীদরা বুকের রক্ত ঢালেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় স্পষ্ট ছিল। সেটি এই যে, স্বাধীন বাংলাদেশ চলবে অসাম্প্রদায়িক ধারায়। সেই অনুসারে সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে। কিন্তু সে পথে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করা হয়নি। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রভৃতিকে রাষ্ট্রীয় নীতি ও কাজকর্মে প্রবেশ করানো হয়েছে। এখনো সেই অধোগতির পথকেই নানাভাবে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। শুধু সাম্প্রদায়িক অপশক্তিই নয়, উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী কালো শক্তিকেও তার অশুভ ভিত রচনার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িক মনোভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রসারিত হয়েছে। স্কুলের পাঠ্যবই সাম্প্রদায়িকীকরণ করে ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে বিপথগামী করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার কাছে নানাভাবে আত্মসমর্পণ করা হচ্ছে। জনগণের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-প্রগতিবাদী চেতনা সৃষ্টির জন্য ভাবাদর্শগত ও সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন পরিচালনার কাজও দুর্বল এবং বহুলাংশে অবহেলিত থেকে গেছে। বুর্জোয়া শাসনের বদৌলতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ নীতি এবং তার প্রয়োগও এখন অনেকটাই পরিত্যক্ত।
পাকিস্তানে চালু ছিল সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্তবাদের নিয়ন্ত্রিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। পূর্ব বাংলায় ধ্রুপদী সামন্তবাদের অস্তিত্ব ততটা না থাকলেও সামন্তবাদের অবশেষ হিসেবে নানা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। সাধারণ মানুষ জাতিগত শোষণের পাশাপাশি শ্রেণিগত শোষণে নিষ্পেষিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল বাংলার শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। মুক্তিযুদ্ধে তাদেরই অংশগ্রহণ ছিল প্রশ্নাতীতভাবে প্রধান। এদেশে শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে সাম্যের সমাজ নির্মাণের সংগ্রাম বহু বছর ধরে পরিচালিত হচ্ছিল। সমাজতন্ত্র হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয় স্লোগান। সমাজতন্ত্রের ধারায় স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে পরিচালিত হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সংবিধানে তাই অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ‘সমাজতন্ত্র’।
সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করার পাশাপাশি, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোন্ ধরনের নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে তারও বিস্তারিত নির্দেশনা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলেই দেশের অর্থনৈতিক নীতি-ব্যবস্থা সম্পর্কে সাংবিধানিক নির্দেশনা স্পষ্ট হবে। সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে— কৃষক ও শ্রমিককে- এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি প্রদান করা।’
এই সংবিধানে আরো বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উত্পাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং … নাগরিকদের জন্য … (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, ও চিকিত্সাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।’
সংবিধান থেকে এ ধরনের আরো ডজন-ডজন উদ্ধৃতি দেয়া যায় যেখানে ‘সমাজতন্ত্র’ অভিমুখীন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এইসব নীতি পরিত্যাগ করে দেশ এখন (প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে) অবাধ মুক্তবাজার নীতির ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদের পথে পরিচালিত হচ্ছে। অর্থনীতি এখনো সেই ধারাতেই চলছে। ‘সমাজতন্ত্র’ এখন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত।
চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, তথা— ধর্ম-নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ও সমাজতন্ত্র— এই চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সবগুলোই এখন পরিত্যক্ত অথবা খর্বিত। তাহলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারার কীই-বা অবশিষ্ট থাকলো? সবই তো হাতছাড়া হয়েছে ও হচ্ছে। সাড়ে চার দশকের অভিজ্ঞতা একথা প্রমাণ করে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারা তথা চার নীতির পথে দেশের অগ্রযাত্রার জন্য দেশের বুর্জোয়া শ্রেণি ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী দলগুলোর ওপর নির্ভর করা যায় না। অথচ, সেই চার নীতির ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনাটাই বর্তমানে জাতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কর্তব্য। তাই, সেটি করতে হলে অনেক কাজের মধ্যে একটি বড় কাজ হলো, দেশ থেকে বিভিন্ন লুটেরা বুর্জোয়া শক্তির পর্যায়ক্রমিক শাসনের ধারাবাহিকতার অবসান ঘটানো। শ্রমজীবী মানুষসহ জনগণের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা।
n লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)