আলা জাবের। ফিলিস্তিনি এই তরুণী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী, থাকেন শামসুন্নাহার হলে। আগ্রহ থেকে বাংলা ভাষা শিখছেন তিনি। বাংলা কেমন লাগছে, জানতে চাইলে আলা জাবেরের মুখে ফুটে ওঠে প্রশান্তির হাসি। ভাঙা ভাঙা বাংলায় এই তরুণী বলেনÑ ‘এক বছর আগে পড়াশোনার জন্য বাংলাদেশে এলেও প্রথমে প্রয়োজনে বাংলা ভাষা শিখেছি। কিছুদিন পরই বুঝতে পারি বাংলা ভাষার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। এখন তো সব জায়গা সব কিছুতেই বাংলা বলতে ভালবাসি। এই ভাষায় আলাদা একটা টান অনুভব করছি। ভাষার কারণে বাংলার প্রেম-প্রকৃতিতে জড়িয়ে গেছে মন-প্রাণ।’ বাংলা ভাষাটাকে পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে চান ভালবাসা দিয়ে, এমনটা জানাতেও ভুললেন না তিনি। আলা জাবেরের মতো অনেক বিদেশি নাগরিক বাংলার প্রেমে ডুব দিয়েছেন। তুলে আনার চেষ্টা করছেন বাংলা ভাষার মণিমুক্তা।
পরিসংখ্যানবিদরা জানান, বাংলা ভাষায় এখন বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। ২০৫০ সাল নাগাদ কেবল ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ। অন্যদিকে পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ সিয়েরালিওন। ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশটির প্রেসিডেন্ট আহমদ তেজান কাববা বাংলাকে তাদের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। সিয়েরালিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকার কারণেই বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে এবং ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটেও বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দরে বাংলায় ঘোষণা দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বিদেশিদের বাংলা শেখানো হয়। চীন, কোরিয়া, রোমানিয়ার ছেলে-মেয়েরা এখানে আসছেন বাংলা শিখতে। কেউ শিখছেন কাজের জন্য, কেউবা নিছক ভালবেসে। প্রতিবছর দুই হাজার শিক্ষার্থী আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়। এখান থেকেই বাংলা শেখা চীনের চাং জিং বলেন, ‘বাংলা এত মজার ভাষা। কবিতা পড়তে ভালো লাগে, বাংলা গান শুনতে ভালো লাগে। আমি বাংলায় একটি গল্প লিখতে চাই। নিজের ভাষার পর বাংলার প্রতি বেশি টান অনুভব করি আমি।’
ফ্রান্সের লিপস মর্গান বলেন, ‘এখানে কোনো একটা এনজিওতে কাজ করার ইচ্ছা আছে। এখানকার মানুষ অনেক ভালো। তাদের ভাষা অনেক মধুর। তাই বাংলা ও বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে চাই।’
আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক রুপা চক্রবর্তী বলেন, বাংলা ভাষার প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ অনেক বাড়ছে। যে কারণে বাংলা ভাষা শেখার জন্য প্রতিবছরই অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে আসে। বাংলার প্রতি আগ্রহের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। তাই অনেক বিদেশি এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে ও কাজ করতে আগ্রহী। তা ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী বাংলা ভাষার ইতিহাস, বাংলার বিভিন্ন সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা নিতেও বাংলা শিখছেন।
ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য মতে, বিদেশিদের বাংলা এবং বাঙালিদের বিদেশি ভাষা শেখানোর লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাংগুয়েজ বা আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বাংলা শেখার জন্য ১৩ বিদেশিসহ দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে ভাষা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এক বছরের বাংলা ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু রয়েছে। এ ছাড়া জুনিয়র, সিনিয়র, ডিপ্লোমা ও উচ্চতর ডিপ্লোমা নামে চার বছর মেয়াদি কোর্সও চালু রয়েছে বিদেশিদের জন্য। প্রতিবছরে গড়ে ২০ জন বাংলা ভাষা শিখছে।
এ বিষয়ে আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত সচিব ইমরান আহমেদ খান বলেন, বেশিরভাগ বিদেশি শিক্ষার্থী শুধু ভাষা শেখার জন্য বাংলাদেশে আসে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ কোরিয়া ও চীনের নাগরিক।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও সাউথ এশিয়ান ল্যাংগুয়েজ স্টাডিজ বিভাগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, রাশিয়ার মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়, প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্রান্সের সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, জার্মানির হাইডেলবার্গ, পোল্যান্ডের ওয়ারশ, কানাডার অটোয়া, জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, চীনের চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়। একইভাবে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে, রেডিও জাপান, চীন আন্তর্জাতিক বেতার থেকে বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। মস্কো রেডিও কিছুদিন আগ পর্যন্ত বাংলায় অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। এ ছাড়া ব্রিটেন ও আমেরিকা থেকে অনেক বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এসব দেশে প্রচুর বাংলা টিভি চ্যানেলও রয়েছে, আছে রেডিও স্টেশনও। কানাডায় সম্প্রতি বাংলা রেডিও স্টেশন ‘রেডিও মেট্রো’ যাত্রা করেছে, যেখানে কাজ করছেন অনেক বিদেশি।
বিদেশিদের ভাষা শেখার আগ্রহ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, বাঙালিদের সঙ্গে বিশ্বের অনেক মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করে বাংলা ভাষা শিখতে আগ্রহী। বাংলাকে নিয়ে এত বেশি ইতিহাস আছে যা জানার জন্যই তাদের এই আগ্রহ। আর একজন বাঙালি হিসেবে তা আমাদের জন্য গর্বের কারণ।