সাফল্যের শীর্ষে বিদ্যুৎ ২০২০ সালের মধ্যেই আলোয় ভরবে দেশ

একসময় বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া ছিল যেন ‘ভাগ্যের’ ব্যাপার। নানা পর্যায়ে ধরাধরি করেই পেতে হতো বিদ্যুৎ সংযোগ। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উত্পাদন কম থাকাই এর কারণ।

অথচ আজ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এলাকায় বিদ্যুতের গ্রাহকের সংখ্যা এক কোটি ৭৮ লাখ। আগামী জুন পর্যন্ত নতুন আরো ২২ লাখ পরিবারকে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে গ্রাহকসংখ্যা হবে দুই কোটি। আর ২০২০ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হবে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, আট বছর আগেও বিদ্যুতের উত্পাদন ছিল মাত্র পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। আর এখন বিদ্যুৎ উত্পাদনে ১৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ। এই পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। বিদ্যুতের এই সাফল্য প্রভাব ফেলেছে দেশের অর্থনীতিতে। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ অর্থনীতির দেশের অন্যতম হবে বাংলাদেশ।

ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার সংসদে জানিয়েছেন, ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে উত্পাদনক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কার্যক্রম চলছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার ২০২০ সালের মধ্যে সারা দেশের মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনার কর্মসূচি নিয়েছে। এ লক্ষ্যে একটি প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৩১টি উপজেলায় শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে।

আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর নাগাদ দেশের ৪৬০টি উপজেলার শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ চলছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৩৬ হাজার ৯১২ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে বর্তমানে ১৬টি প্রকল্পের কাজ চলছে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এক দিনের মধ্যে গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ার জন্য।

এ বিষয়ে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেন, ‘নতুন সংযোগ চাইলে গ্রাহককে এক দিনের মধ্যেই সংযোগ দিতে হবে। এ জন্য যা যা প্রয়োজন তাই করুন। ’

বড় প্রকল্পগুলো আকার নিচ্ছে : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রকেই একসময় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বলে মনে করা হতো। ওই রকম ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অর্থ পেতেও দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে বাংলাদেশ; অথচ ঋণ পায়নি। কিন্তু মাত্র আট বছরের মাথায় পরিস্থিতির এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ পেতে অসুবিধা হচ্ছে না বাংলাদেশের।

শুধু তাই নয়, এ রকম কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। এর অন্যতম পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরসংলগ্ন এলাকার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সরকারি মালিকানাধীন কম্পানি নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি ও চীনের প্রতিষ্ঠান সিএমসির যৌথ মালিকানায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে।

এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট হবে সেখানে। ২০১৯ সাল নাগাদ সেগুলো থেকে উত্পাদন শুরু হবে। একই ক্ষমতাসম্পন্ন আরো দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী ও বাগেরহাটের রামপালে। এ ছাড়া মহেশখালীতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।

কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতেও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র।

এ ছাড়া পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় সরকারি কম্পানি আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন চীনের প্রতিষ্ঠান এনার্জি চায়নার সঙ্গে যৌথভাবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এ জন্য ৯৮০ একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।

মহেশখালীতে মালয়েশিয়ার সরকারি কম্পানি তেনেগা বারহেডের সঙ্গে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি এবং চীনের কম্পানি চায়না হুদিয়ান হংকংয়ের সঙ্গে একই ক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একই উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে বাগেরহাটের রামপালে।

তবে শুধু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই নয়; সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প দুই হাজার কোটি ডলারের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ও পরের বছরের ডিসেম্বরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে এ কেন্দ্র থেকে। এর মাধ্যমে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে বিশ্বের ৩১তম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বাংলাদেশ।

যুগোপযোগী পরিকল্পনা : সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের প্রাক্কালে বর্তমান সরকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে বিদ্যুৎ সংকটের দ্রুত উন্নতির ব্যাপারে। এ জন্য তখন সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। গত আট বছরে স্বল্প মেয়াদে উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে চালু হবে মধ্যমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদন হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

আঞ্চলিক সহযোগিতায় মিটবে বিদ্যুতের চাহিদা : বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে আরো জানা গেছে, হিমালয় থেকে উৎসারিত বিভিন্ন নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে প্রায় দেড় লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদনের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ভারত, নেপাল ও ভুটান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জলবিদ্যুৎ উত্পাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ চাইছে হিমালয়ের এই ব্যাপক জলবিদ্যুতে বিনিয়োগ করতে। সেই বিদ্যুৎ দেশে আনার জন্য ভারতের ভূমি ব্যবহারের অনুমতি চাইছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে ভারত এতে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে নেপাল থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনতে চায় বাংলাদেশ। আর ভুটানে জলবিদ্যুতে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চায় ঢাকা।

শুধু হিমালয় থেকে প্রবাহিত তিন দেশের জলবিদ্যুতেই নয়; বাংলাদেশ ভারতকে বিদ্যুতের করিডর দেওয়ার বিনিময়ে তাদের বিদ্যুৎ পেতে চায়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে যে ব্যাপক জলবিদ্যুৎ উত্পাদিত হবে তা ভারতের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য ভারতের চাই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের করিডর। ইতিমধ্যে বিদ্যুতের একটি করিডর দেওয়ার ব্যাপারে সায় দিয়েছে বাংলাদেশ। আর ওই বিদ্যুৎ থেকে কিছু বিদ্যুৎ বাংলাদেশকেও দেওয়া হবে।

ইতিমধ্যে ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ভারত থেকে আরো এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হবে। ভারতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ভারতের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ ভারতের ঝাড়খণ্ডে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ আসবে বাংলাদেশে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে আদানির সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে পিডিবির।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় অভিন্ন বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক স্থাপন করে ২০২১ সালের মধ্যে আরো ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারে পারস্পরিক সম্পর্ক শক্তিশালী করতে পারলে এ অঞ্চলের জ্বালানি ও বিদ্যুতের সংকট দূর হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন। ’

পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উত্পাদনে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শুধু কয়লা, গ্যাস কিংবা জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনাই নয়; সৌরবিদ্যুতের ওপরও জোর দিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে রামপাল বিদ্যুকেন্দ্রের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট সৌরভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর আগে এখানে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

জানা গেছে, সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩৪টি সৌরবিদ্যুতের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ১০০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হবে ফরিদপুরে। এটি নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কম্পানির মালিকানায় স্থাপিত হচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৬৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ থাকবে ৪২২ মেগাওয়াট, বায়ুবিদ্যুৎ থাকবে ২৫০ মেগাওয়াট; বাকিটা আসবে বায়োম্যাস, বায়োগ্যাস ও পানি থেকে।

এ ছাড়া আরইবি এলাকায় ইজি বাইকের ব্যাটারি চার্জিংয়ের জন্য এরই মধ্যে আটটি সোলার চার্জিং স্টেশন নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া ৪০টি সোলার সেচ পাম্প স্থাপনের পাশাপাশি আরো দুই হাজার সোলার সেচ পাম্প স্থাপনে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৫০ লাখ পরিবার সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের সংখ্যায় পৃথিবীতে এটাই সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে তিন হাজার ১৬৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদন করতে চায় সরকার।