কাগজের বক্স তৈরি করে যেভাবে স্ববলম্বী না’গঞ্জের নাসিমা

নাসিমা আর তার স্বামী জাহিদ মিয়ার তৈরি করা মিষ্টির বক্সের (মোড়ক) এখন দোকানে দোকানে বেশ চাহিদা। নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন হাজার থেকে দুই হাজার বক্স তারা সরবরাহ করেন। আর এভাবেই কাগজের বক্স তৈরি করে নিজেদের সংসারের অভাব দূর করেছেন তারা। শুধু তাই নয়, নাসিমার সঙ্গে কাজ করে তার গ্রামের আরো কয়েকজন নারী জীবিকা নির্বাহ করছেন। অথচ তিন বছর আগেও নাসিমাদের অবস্থা এমন ছিল না। স্বামীর পোলট্রি ফার্ম ছিল। কিন্তু লোকসানের কারণে ব্যবসা গুটাতে বাধ্য হন। শুরু হয় কষ্টের জীবন। প্রতিদিনই স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হতো। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাগজের (হার্ডবোর্ড) বক্স তৈরির প্রশিক্ষণ নেন নাসিমা। এরপর স্বামীর সহায়তায় নিজেই মিষ্টির বক্স ছাড়াও বিরিয়ানির প্যাকেট, উপহার বক্স তৈরি করে বাজারজাত করা শুরু করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই দম্পতিকে। আর এমনটি সম্ভব হয়েছে তাদের নিরলস পরিশ্রম আর অদম্য মনোবলের কারণে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আড়াই হাজার উপজেলার ব্রামন্দি ইউনিয়নের নোয়াদ্দা গ্রামটি এখন বেশির ভাগ সময় মুখরিত থাকে নাসিমার বাড়ির বোর্ড কাটার মেশিনের শব্দ আর কারখানার কর্মীদের পদচারণায়। গাড়িতে মাল তুলে দেওয়া, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হার্ডবোর্ড কাটা, কাগজে আঠা লাগানো, আঠা তৈরি করা- এমন আরও নানা কর্মযজ্ঞ চলে ওই বাড়িতে। নাসিমার সঙ্গে কাজ করেন পাড়ার খাদিজা, হাজেরার মতো হতদরিদ্র ১০ নারী। যাদের জীবনে কোনো সাধ-আহ্লাদ ছিল না। বাচ্চাদের স্কুলে দেওয়ার নিশ্চয়তা ছিল না, ছিল না একটা পছন্দের পোশাক কেনার স্বাধীনতা। শুধু স্বামীর স্বল্প আয়ে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকার লড়াই ছিল। আর এখন নাসিমার কারখানায় কাজ করে তারাও রীতিমতো স্বাবলম্বী।

যেভাবে শুরু: জানা গেল, ২০১৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ‘ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট ফর পুওর অ্যান্ড ভালনারেবল ওমেন ইন বাংলাদেশ’ (ইইপি) প্রকল্পের কাজ শুরু করে ব্র্যাক। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে একেবারে হতদরিদ্র নারীদের এই প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করা হয়। অতদরিদ্র নারীর তালিকায় স্থান পায় নাসিমার নাম। এখানেই বক্স তৈরিতে তিন দিনের প্রশিক্ষণ নেন নাসিমা। সেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই জেন্ডার বিষয়ক ট্রেনিংও দেওয়া হয়। এই ট্রেনিং বদলে দেয় জাহিদের মনোভাব। এখন সে তার স্ত্রীর পরম সহযোগী।

নাসিমা জানান, এদিক ওদিক থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ করে তারা কারখানাটি শুরু করেন। তখন বোর্ড কিনে বাজারে মেশিন দিয়ে কেটে আনতে হতো। কাটার জন্য ব্যয় হতো বাড়তি কিছু টাকা। এক পর্যায়ে দুচারজন সহকর্মী যুক্ত হতে থাকে তাদের কারখানায়। বাজারে চাহিদাও বাড়তে থাকে নাসিমার বক্সের। চাহিদা অনুযায়ী মাল সরবরাহের জন্য তাদের আরো পুঁজির প্রয়োজন হয়। আবার তারা ব্র্যাকের দ্বারস্থ হন, এবার পুঁজি দাবি করেন। ব্র্যাক বাজারে নাসিমার তৈরি বক্সের চাহিদা, তার ব্যবসায়িক অবস্থা সব পর্যবেক্ষণ করে দেড় লাখ টাকা ঋণ দেয়। ব্যাস ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় কেনা হয় বোর্ড কাটার মেশিন। এই মেশিন ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার পরিবেশও বদলে যায়। এখন বাড়তি আয়ের জন্য রাতের পর রাত জেগে কাজ করেন নাসিমা। ঋণের টাকা কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, এটাই তার উদ্দেশ্য। সহকর্মীদের মাসে সব মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা বেতন দেন নাসিমা। নাসিমার তৈরি বিভিন্ন মাপের বক্স বিক্রি হয় ৫ টাকা, ৮ টাকা, ১০ টাকা ও ১২ টাকা দরে। খরচ বাদ দিয়ে বক্সভেদে ২ থেকে ৫ টাকা তার লাভ থাকে। মাসে তার এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মতো বক্স বিক্রি হয় ,এতে তার লাভ হয় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। আড়াইহাজার ও নরসিংদীর ১৫টি দোকানে বক্স দেন নাসিমা। আরও বিশটি দোকানে চাহিদা আছে। কিন্তু পুঁজির অভাবে তিনি এই চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। ঋণের জন্য বেশ কয়েকবার সোনালী ব্যাংকে যোগাযোগ করে আশ্বাস পেলেও ঋণ পাননি এখনো।

শুরুতে কি সকলের সহযোগিতা পেয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাসিমা বলেন, ‘অপরের কথা কি বলুম আপা, আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষই আমারে মন্দ বলছে। কিন্তু তাতে কি যায় আসে। একমাত্র মেয়েকে লেখাপড়া শিখাইয়া বড় বানাইতে চাই। আমার কারখানায় দশজন মানুষ খাটে, আয় করে। এইডা ঐ কথার চেয়ে অনেক বড় না আপা?’

নাসিমার কারখানায় তিন বছর ধরে কাজ করা খাদিজা জানান, এইখানে কাজ করে সে সপ্তাহে ৬শ থেকে ৮শ টাকা আয় করে। যা দিয়ে তার মেয়ের পড়াশুনা চলে। নিজের পছন্দমত পোশাক কেনে। একটু একটু করে জমায়ও।

এই নারীদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান যেই নাসিমা তাকে নিজের ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন করলে জানান, গত বছর আড়াইহাজারের শ্রেষ্ঠ ‘জয়ীতা’ নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এ সব কিছু তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজের জন্য ও এই গ্রামের হতদরিদ্র নারীদের জন্য আরও বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

ইইপি প্রকল্পের সিনিয়র ম্যানেজার গোলাম মোস্তাফা ইত্তেফাককে বলেন, তিন বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় যারা সফল হয়েছেন তাদের মধ্যে নাসিমা অন্যতম। নাসিমার কারখানায় ট্রেনিং নেওয়া অন্য নারীরাও কাজ করছে। তার বানান বক্সও মানসম্পন্ন। তাই প্রয়োজনীয় পুঁজি পেলে তার স্বপ্ন বাস্তব হতে বেশি সময় লাগবে না।