কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের দিকদর্শন

কলকাতা বইমেলার দশদিনের আন্তর্জাতিক উত্সব সমাপ্ত। সন্ধ্যায় নিয়মিত উচ্ছ্বাস, পায়ে পায়ে হাঁটা, লিটল ম্যাগের সরব প্রতিযোগিতা, তারুণ্যের মনোহর হুজুগ, কর্পোরেটকর্মীদের ব্রান্ডপ্রচারের হাস্যকর প্রচার, যুবক-যুবতীদের সেলফি প্রেমের হাসি, ঝকমকে আলোর পাশে বড়ো বড়ো বইমণ্ডপ, কবিতা ও ছবিতার অকৃত্রিম সহাবস্থান—কিছুই ফিকে হবার নয়, সবই ঝলমলে স্মৃতির মতো আবার এক বছর জুড়ে হূদয়ের আকুতিকে সঙ্গ দেবে। রবিবার রাত সাড়ে নয়টায় ঘণ্টা বাজল, উচ্চারিত হলো লাখ লাখ কণ্ঠের সবল প্রত্যাশা— আসছে বছর আবার হবে, প্রশ্নও উঠল—কোথায় এখানে না অন্যত্র, জবাব অনিশ্চিত, বললেন না মহানগরের মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় কিংবা কোনো গিল্ড কর্তা। শুধু এইটুকু জানা গেল—২০১৮ এর ৩১ জানুয়ারি শুরু হবে, আর সমাপ্তি ১১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু যেখানেই হোক না কেন, ধারাবাহিকতার অঙ্গচ্ছেদের কোনো আশঙ্কা নেই, বই তার বুক চওড়া করে, মাথা উঁচিয়ে মেলায় আলো ছড়াবে, ছড়াতে থাকবে, হার মানবে না, হারিয়ে দেবার আওয়াজ উঠলে জনরোষ আঁছড়ে পড়বে। কেননা নানা বিবর্তন, দৃষ্টিকটু রদবদল, বইয়ের পাশাপাশি না-বই, অ-বই, পণ্যসামগ্রীর থাবা ঝাপটানি সত্ত্বেও বিশ্বের বৃহত্তম এ উত্সব (জনসমাগমের দিক থেকে) অখণ্ড বাঙালির প্রাণচাঞ্চল্য, রুচিবোধ, ইহজাগতিকতা ও লোকায়ত চিন্তার আরেক বলবান অবলম্বন হয়ে উঠছে। পরিচালনার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্যুতি, সতর্ক হয়েও অসতর্ক পদক্ষেপ, আপসকামিতা, অনৈক্যের চাপা স্বর নিয়েও বইতরঙ্গের স্রষ্টারা স্বধর্মে অক্ষত, অম্লান। হেমন্ত অথবা বর্ষাহীন মরশুম সমুদ্রের আবেগ আর কোলাহলকে, ভেতরের গম্ভীর প্রবাহকে কখনও দাবিয়ে রাখতে পারে না।

তেমনি নিন্দুক, অতিনিন্দুকের চক্রান্ত, অপপ্রচার, বিদ্রূপ পুস্তকময়তার বিস্তার ও বৈভবকে রুদ্ধ অবরুদ্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এবারের বইমেলাও এর একটি বেনজির অভিব্যক্তি। নেতির চর্চা— এই হয়নি, সেই হয়নি— এ রকম কত কথা বলবার সহজ অভ্যাস আমাদের পেছন ছাড়ে না, কিন্তু বাড়তি কী পাচ্ছি, আগের তুলনায় বিশেষ বিশেষ সংযোজন কোথায়, মেলার অভিমুখ কী, কোন বার্তা ছড়াতে চায় তার সাড়ম্বর আয়োজন, তা আমরা খতিয়ে দেখি না, এজন্য সম্ভবত তৃতীয় নয়নের নিরপেক্ষ, প্রশ্নমুখর, নির্মোহ, বিমুক্ত চোখ চাই। মেলাটি যে ক্রমশ ভৌগোলিক, রাষ্ট্রিক সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করছে, যেমন ভেতরে, তেমনি বাইরে উদযাপনে, নির্দিষ্ট লক্ষ্য আর প্রতিশ্রুতি নিয়ে, তা বিশদ, সুদৃঢ় বাক্যে বলা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিকতা বলতে—দেবে, নেবে আর মেলাবে-এর যে দর্শনকে গ্রহণ করেছিল উনিশ-বিশ শতকের বাঙালি মনীষা এবং সাংস্কৃতিক দেশভাগের সব অপচেষ্টাকে ফুঃ বলে উড়িয়ে দিতে চাইছিল, ওই ইচ্ছা কানায় কানায় পূর্ণ করতে কলকাতা বইমেলা অক্ষরে অক্ষরে অঙ্গিকারবদ্ধ। এর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি ও বিশ্বময়তার ঐকতান আর কী হতে পারে! একথা বলার জন্য গোটা কয়েক উদাহরণ যথেষ্ট। এই যেমন নিকটতম আত্মীয় বাংলাদেশের, প্রতিবেশী নেপাল ও পাকিস্তানের, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকাসহ চার মহাদেশের হূদয়বৃত্তির সচেতন উপস্থিতি, লেখক-কবিদের মতবিনিময়, কাছে আসার এবং একে-অন্যকে কাছাকাছি বসাবার একান্ত আগ্রহ কি প্রমাণ করে না, বইমেলা বিভাজনের, ঘৃণার, আত্মম্ভরিতার বিরুদ্ধে শুধু সোচ্চার নয়, পুস্তক দিয়ে পুস্তকের ভাবানুবাদ দিয়ে দুনিয়ার শুভবোধকে সংগঠিত করতে বদ্ধপরিকর।

এই যে মিলনমেলা প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের বই-মণ্ডপের বহির্অঙ্গে দিনাজপুরের কান্তজি মন্দিরের সুউচ্চ, প্রতিস্পর্ধী শিল্পিত অবস্থান; এই যে দশদিন জুড়ে ঢাকার ৩১ প্রকাশনা সংস্থার উত্সব-উত্সব চেহারা; এই যে ওপারের কবি- লেখক- চিত্রকর্মীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ; এই যে বাংলাদেশ দিবসে এপারের নাট্যকার ব্রাত্য বসুর পাশাপাশি ওপারের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর—আর মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির দৃপ্ত উপস্থিতি; বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান- এর সংযত উদ্ভাস; কবিতা নিয়ে মন্ত্রী, আমলা ও কবিদের দীর্ঘ আলোচনা; ঢাকা থেকে প্রকাশিত বই কিনতে এ বঙ্গের পাঠকদের উপচে পড়া হিড়িক এবং প্রতিদিনের সাহিত্যবাসরে দেশি-বিদেশি লেখকদের ঋদ্ধ উচ্চারণ কি প্রমাণ করে না যে, অসংযম, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে উত্সবের আমরা চিন্তার দীনতা আর সাংস্কৃতিক অহং-এর তোমরা-র মোকাবিলায় একই সুরে, একই ভাষায়, একই দৃঢ়তায় মিনার গড়তে চাইছি। এখানে বাঙালি অখণ্ড, অবিভাজ্য। সত্তর বছরের ভাঙন, উপহাসের তীব্রতা, অনেকানেক দুঃস্বপ্ন অতিক্রম করে সে বলতে চায়, মর্মান্তিক দহন এড়িয়ে নির্মাণ আর সৃষ্টির অঙ্গনে সে অতন্দ্র প্রহরী। তার সেকাল, একাল, ভবিষ্যত্ এ মঞ্চে একাকার। সঙ্গী ঐতিহ্য, সঙ্গী ভালোবাসার ধন, সঙ্গী হূদয়বৃত্তি নিয়ে একসঙ্গে থাকার, ক্রমশ হয়ে ওঠার অদম্য স্পৃহা। এই চত্বরে সংশয় নেই, প্রশ্ন নেই, তথাকথিত বিচ্ছিন্নতা বোধের কোনো প্রতিরোধ, কাঁটা, সন্ত্রাসের ঠুনকো উপদ্রবকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নয় তার নির্বিশেষের অভিপ্রায়। বইমণ্ডপের অবয়বে বীরগঞ্জের যে ঐতিহাসিক উপাসনাগৃহের টেরাকোটার শিল্পসমাবেশ কলকাতাবাসী অবাক হয়ে দেখল এবং বুঝতে পারল—বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব অক্ষত রেখে চিরায়ত অভ্যাসকে নিরন্তর জাগ্রত রাখার দাবি তুলছে, যেমন গঠনশীল রাজনীতিতে, তেমনি সমাজনীতিতে। বিশ্বের পুস্তকপ্রেমীরাও জানতে পারলেন, অতীতের সঙ্গে নিস্পৃহ বসবাস নয়, ইতিহাসের স্মৃতিকে জড়িয়ে স্বপ্ন দেখছে তার জনসত্তা। মাথা উঁচু করে আবৃত্তি করছে, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি’, যে পথে হেঁটেছে হূদয় সে দিকেই হাঁটব। পরোক্ষ এ বার্তায় এবারের কলকাতা পুস্তকমেলা উজ্জীবিত, নতুন করে আবিষ্কার করল বাংলাদেশের দিক্দর্শন। এ মহান প্রাপ্তির সামনে মেলার খুদে সব গলদ তুচ্ছ, তুচ্ছতর। প্রত্যাশা বড়ো হচ্ছে, জানা গেল, ঢাকায়ও অনুরূপ বইমেলার সমবেত প্রার্থনা জাগছে, যেখানে এক হবার সুযোগ পাবে বিশ্বের মুদ্রিত শুভবুদ্ধি। আমিন।