লেখক : কর্নেল এস এম শওকত আলী (অব.) মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ যে উন্নয়নের মহাসড়কে দণ্ডায়মান সে কথা তার চিরশত্রুও অস্বীকার করবে না। উন্নয়নের মহাযজ্ঞ যে চারদিকে রণিত হচ্ছে তা একটু তীক্ষ দৃষ্টিতে অবলোকন করলেই অনুভূত হবে। ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪৬৫ মার্কিন ডলার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.১৫ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঊর্ধ্বে। এরই মধ্যে বিশ্বদরবারে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। তাবৎ বিশ্বের ধনী দেশগুলো বাংলাদেশের অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থ বিনিয়োগের জন্য উদগ্রীব। তা ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং তার প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ এর মধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে। রাশিয়ার সহায়তায় এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। আরেক অগ্রাধিকার প্রকল্প হলো রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্প, যার আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের জুন মাসে। আনোয়ারায় এক হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু হওয়ার পথে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস টার্মিনাল নির্মাণের মূল কাজ শুরুর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি কম্পানির সঙ্গে ঠিকাদারি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
যোগাযোগ ক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের মহাসড়ক তৈরি প্রকল্প এর মধ্যেই শেষ হয়েছে। জয়দেবপুর থেকে চন্দ্রা-টাঙ্গাইল হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেন মহাসড়কের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে, যা পরে এলেঙ্গা থেকে বগুড়া-রংপুর পর্যন্ত ২৫১ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কে উন্নীত করা হবে। ঢাকার কাঁচপুর থেকে সিলেটের তামাবিল পর্যন্ত ২৮৩ কিলোমিটার মহাসড়ক ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনে উন্নীত করা হবে, এর অর্থ জোগান দেবে চীন। দেশের প্রথম ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত চার লেনের করা হবে, যার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং এর ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ২৫২ কোটি টাকা। এ ছাড়া ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে হবে ঢাকার মদনপুর থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেটের আগে সেলিমপুর পর্যন্ত, যার দৈর্ঘ্য হবে ২১৮ কিলোমিটার আর প্রকল্প ব্যয় হবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে হবে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিদ্যমান চার লেন মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে। বন্দরনগর চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘এক নগরী দুই শহর’-এর মতো গড়ে তুলতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা হবে। টানেলটি হবে বাংলাদেশে এশীয় মহাসড়কের অংশ। ৩.৪ কিলোমিটার কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা, যার সিংহভাগ জোগান দেবে চীন সরকার।
ফিরে দেখা যাক রেলপথ উন্নয়নের দিকে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প পাস করা হয়েছে, যার খরচ হবে ৩৪ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে মাত্র। ভবিষ্যতে এ রেলপথে দ্বিতীয় রেলপথ নির্মাণ ও বরিশাল ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। রাজধানী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগের জন্য চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস করা হয়েছে। এ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ছাড়া পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালে এক হাজার ১২৮ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
রাজধানী ঢাকা শহরের দুর্বিষহ যানজট নিরসনকল্পে গ্রহণ করা হয়েছে বহুমুখী প্রকল্প; যার জন্য আনুমানিক ব্যয় হবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। রাজধানীতে ২০০৫ সালে প্রথম উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয় মহাখালী লেভেল ক্রসিংয়ের ওপর, এরপর চালু হয় খিলগাঁও উড়াল সেতু। যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র হানিফ উড়াল সড়কসহ অন্য আরো কয়েকটি উড়াল সড়কের কাজ শেষ করে চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে কুড়িলের মাল্টি ডাইরেকশনাল উড়াল সড়ক, বনানী উড়াল সড়ক ও সাতরাস্তা মোড় থেকে মগবাজার চৌরাস্তা পর্যন্ত উড়াল সড়ক। মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের কাজ প্রায় সমাপ্তির পর্যায়ে। এ ছাড়া সেতু বিভাগের অধীনে কাজ চলছে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়কের। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা; যার প্রাথমিক নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। সেতু বিভাগের ঢাকা শহর ঘিরে অন্য বড় প্রকল্প হলো বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়ার নবীনগর হয়ে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক নির্মাণ কাজ। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ২০২৪ সালের মধ্যে তিনটি পথে মেট্রো রেল চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এরই মধ্যে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে পল্লবী হয়ে রোকেয়া সরণি-খামারবাড়ী-ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-টিএসসি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত (এমআরটি-৬) মেট্রো রেল নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ঢাকায় আরো চারটি রুটে মেট্রো রেল চালুর জন্য যাচাই-বাছাই চলছে। অধিকন্তু ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত শুধু বাস চলাচলের জন্য আলাদা লেন বিআরটি চালু হতে যাচ্ছে ২০১৮ সালে, যার দৈর্ঘ্য হবে ২০.৫০ কিলোমিটার।
আমরা যদি প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হওয়ার পরের বাংলাদেশের চিত্র মানসপটে নিবিড় কল্পনা করি, তবে নিশ্চয় একটা উন্নত বাংলাদেশের ছবিই দেখতে পাব। আর একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ওপরে উল্লিখিত প্রতিটি প্রকল্পই ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা; অর্থাৎ ৮-১০ বছরের মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার যে সংস্কৃতি ও ইতিহাস, সেটা মনের বিদ্যমান উচ্ছ্বাসটাকে অনেক সময় নিবৃত্ত করে দেয়। যত দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে, ততই বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমরা এখনো বহু কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা আশানুরূপ পর্যায়ে উন্নীত করতে পারিনি। যদিও দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোকে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’-এর আওতায় আনা হয়। এ প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদারক করা হয়। আর ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ প্রকল্পগুলো মনিটরিংয়ের জন্য গঠিত কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এত কিছুর পরও কি আমরা প্রকল্পের প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হচ্ছি? মনে হয় না। সাম্প্রতিক এক তথ্য মতে জানা গেছে, প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন, সরকারি কেনাকাটা, জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা গেলে প্রতিবছর দেশের জিডিপি ২ শতাংশ বাড়বে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ প্রকল্পগুলোর কার্যকর তদারক ব্যবস্থা আরো জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রকল্পগুলো যাতে যথাসময়ে শুরু হয়ে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুর্নীতিমুক্তভাবে শেষ হয় সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অপবাদ পেছনে ফেলে পৃথিবীর বুকে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির দেশ হিসেবে এর মধ্যেই চারদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হতে হলে উন্নয়নের টেকসই ধারা অব্যাহত রেখে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক—প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও দক্ষতা অর্জনের সামগ্রিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সে জন্য সব দায়দায়িত্ব শুধু সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না, ১৬ কোটি মানুষকেই সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আমরা যেন সবাই যার যার ক্ষেত্রে সঠিক কাজটি সঠিকভাবে করি। সরকারকে শুধু নিশ্চিত করতে হবে গ্রহণকৃত প্রকল্পগুলো যেন সঠিক সময়ে সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্তভাবে শেষ হয়। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক কবিতায় বলেছেন, ‘শুধু কবিতার জন্য আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়। ’ আমারও এই ষাটোর্ধ্ব বয়সে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়। নিদেনপক্ষে আগামী ১৫ থেকে ২০ বছর।