লেখক – রেজাউল করিম খোকন (ব্যাংকার)
বাংলাদেশের সব এলাকায় এক সময় অগভীর উন্মুক্ত জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও ডোবায় পাওয়া যেত কুঁচে মাছ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা, অতিরিক্ত খরা, জলাভূমি ভরাট, অপরিকল্পিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ এবং মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বর্তমানে এ মাছটি হারিয়ে যাচ্ছে। তবে আনন্দের বিষয় হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন বাণিজ্যিকভাবে এ মাছের উৎপাদনে নিয়োজিত হয়েছেন অনেকেই। কারণ দেশের বাজারে কুঁচের তেমন চাহিদা না থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কুঁচের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশের কুঁচে বিভিন্ন দেশে অল্প পরিমাণে রপ্তানি শুরু হয়ে দিনে দিনে এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সময়ের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলাদেশের কুঁচে মাছ। পিকেএসএফ অর্থাৎ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন প্রথমে সাতক্ষীরা অঞ্চলে কাঁকড়া চাষিদের পাশাপাশি খামারিদের কুঁচে মোটাতাজাকরণে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রদান করে খামারিদের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। খামারিরা তাদের নিত্যদিনের অন্য কাজের পাশাপাশি এ কাজটি করে থাকেন। কুঁচে চাষের জন্য পিকেএসএফ থেকে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ, পুঁজি ও প্রযুক্তি দেয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালীগঞ্জ ও খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলায় কুঁচে চাষ ব্যাপকভাবে শুরু করার পর সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের নীলফামারী জেলার ডোমার, কিশোরগঞ্জ এবং জলঢাকা উপজেলায় এই কর্মসূচি সম্প্রসারিত হয়েছে। নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের উপক‚লীয় অঞ্চল অথবা কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের হাওরাঞ্চলে দেখা গেলেও উত্তরবঙ্গে কুঁচে খুব একটা বেশি দেখা যেত না। এখন ওই অঞ্চলে কুঁচে চাষে উৎসাহী হচ্ছেন অনেকে। সম্প্রসারিত হচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে গ্রাম থেকে গ্রামে, ইউনিয়ন থেকে ইউনিয়নে। কেউ কেউ বিকল্প কিংবা আংশিকভাবে কর্মসংস্থান হিসেবে গ্রহণ করছেন কুঁচে চাষকে। মঙ্গা মোকাবেলায় ২০০৯ সালে অতিদরিদ্র পরিবারগুলো সম্পৃক্ত হয়েছিল পিকেএসএফের সংযোগ কর্মসূচির মাধ্যমে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও পুঁজি পেয়ে আজ তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সংসারে বহুমুখী আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে মর্যাদা বেড়েছে তাদের, বেড়েছে সক্ষমতা। টেকসই উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছেন তারা। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে এসে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন অনেকে। পরিবারে বহুমুখী আয়ের ব্যবস্থা করে আজ তারা মোটামুটি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে কুঁচের দেশি বাজারেও চাহিদা রয়েছে মোটামুুটি। তবে এর ব্যাপক চাহিদা রপ্তানি বাজারে। দারুণ সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে কুঁচে মাছ। গড়ে প্রতি কেজি কুঁচে বিক্রি হয় ৪৫০-৫০০ টাকায়। যদিও কুঁচের এ মূল্য আকারের ওপর নির্ভরশীল। আকার যত বড় দামও তত বেশি। চীন, জাপান, হংকং, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, কোরিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের কুঁচে। নিয়মিতভাবে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কুঁচে পোনা উৎপাদন করা গেলে বাণিজ্যিকভাবে কুঁচে চাষ আরো সহজ হবে। এক সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবায় প্রচুর পরিমাণে কুঁচে পাওয়া গেলেও বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে কুঁচে অনেক কমে গেছে। তবে ছোট ছোট খামারির অংশগ্রহণের ফলে হালে কুঁচের চাষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপাদন বেড়ে চলেছে। বাণিজ্যিকভাবে স্বাদু পানিতে কুঁচে চাষ এবং মোটাতাজাকরণের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে। ছোট ছোট কুঁচে উৎপাদক চাষিরাই পারে বাণিজ্যিক এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে টেকসই রপ্তানি খাতে এ শিল্পকে সমৃদ্ধশালী করতে। কুঁচে চাষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জন্য একটি লাভজনক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। কৃত্রিমভাবে কুঁচের প্রজনন আরো ব্যাপক করা সম্ভব হলে একদিকে যেমন লাভজনক রপ্তানি পণ্যের ধারাবাহিক জোগান দেয়া সম্ভব হবে, অপরদিকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত এ মাছটি সংরক্ষণে জোরালো ভূমিকা রাখাও সম্ভব হবে।
রপ্তানি পণ্য হিসেবে জীবিত কুঁচের যে কদর তার চেয়ে মৃত কুঁচের কদর কোনো অংশে কম নয়। মৃত কুঁচে শুঁটকি করে বিক্রি করা হয় এবং ভেষজ ওষুধেও এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে। অনেকেই কুঁচেকে ব্যথানাশক, রক্ত উৎপাদক ও হজমশক্তি বর্ধনকারী ওষুধ হিসেবে সেবন করে ভালো উপকার পেয়ে থাকেন। যেসব দেশে জীবিত কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি হচ্ছে সেখানে দিনের পর দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে চীনে কাঁকড়া হলো অতি জনপ্রিয় খাবার। সেখানকার কোনো অনুষ্ঠান বিশেষ করে বিয়ে কাঁকড়া ছাড়া সম্পন্ন হয় না। যার ফলে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ কাঁকড়া ও কুঁচে বিদেশে রপ্তানি হয় এর ৯০ ভাগই চীনে যায়। রপ্তানি তালিকায় দারুণ সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচিত হলেও আজকাল কুঁচে রপ্তানি এক চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। কুঁচের পাশাপাশি কাঁকড়াও বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করছে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা। অযথা হয়রানি এবং অবাস্তব রপ্তানি নীতিমালার কারণে হুমকির মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের এক হাজার কোটি টাকার বৃহৎ রপ্তানি খাত কাঁকড়া ও কুঁচে ব্যবসা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কার্গোতে পরপর কয়েকটি শিপমেন্ট আটকে দেয়ার কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে এ ব্যবসার ইমেজ দারুণ সংকটে পড়েছে। যে কারণে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং তাইওয়ান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের আমদানিকারকরা তাদের শিপমেন্ট বাতিল করে দিচ্ছে। এর মধ্যে মোট রপ্তানির ৯০ ভাগই চীনে রপ্তানি হয়। তারা বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাঁকড়া ও কুঁচে আমদানির চুক্তি করেছে বলে জানা গেছে।
১৪৩টি প্রতিষ্ঠান বিমানের কার্গো দিয়ে প্রতিদিন ২৫-৩০ টন জীবিত কাঁকড়া ও কুঁচে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকে। এ রপ্তানি খাতটির বয়স খুব একটা বেশি নয়। ১৯৮৭ সাল থেকে এ দেশ থেকে জীবিত কাঁকড়া ও কুঁচে বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে পুরুষ কাঁকড়া ২০০ গ্রাম ও স্ত্রী কাঁকড়া ১৩০ গ্রামের নিচে রপ্তানি করা যাবে না। বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ আইনের আওতায় এ নীতিমালাটি করা হয়েছে। এই নীতিমালায় শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সম্প্রতি দুটি চালানের তিন হাজার কেজি কাঁকড়া আটক করেন। পরীক্ষা করে দেখা যায় মোট কাঁকড়ার পাঁচ থেকে ছয় ভাঁড়ে প্রতিটিতে পাঁচ থেকে ১০ গ্রাম কম। টানাহেঁচড়া এবং সময়ক্ষেপণের ফলে বিমানবন্দরের কার্গোতেই চীনে পাঠালে আরো ৩০ ভাগ মারা যায়। এর ফলে চীন থেকে পুরো শিপমেন্ট বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এ বিষয়টি বিদেশি ক্রেতারা জেনে যাওয়ায় ইদানীং বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া রপ্তানির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগৃহীত কাঁকড়া, কুঁচে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আনার পর দেখা যায় তাদের শরীর থেকে পানি শুকিয়ে গিয়ে কিছুটা ওজন কমে যায়। সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে কাঁকড়ার শরীর থেকে কিছু সময় পরপর পানি বেরিয়ে যায়। অনেক সময় কাঁকড়ার একটি পা খসে পড়লে তার ওজন পাঁচ থেকে ছয় গ্রাম কমে যায়। এ ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া ও কুঁচের চালান আটকে দেয়া হয়েছে।
যদিও পরিবেশবিদদের অভিমত, কাঁকড়া দেশের পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই অধিক পরিমাণ কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবে দেশে উৎপাদিত কাঁকড়ার মোট ১০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর কারণ হলো, একটি স্ত্রী কাঁকড়া একবারে প্রায় ১৫ লাখ ডিম পাড়ে। এই ১৫ লাখ ডিমের মধ্যে ৫-৭ ভাগ বাচ্চা জন্ম নেয়। তাই প্রতিদিন ২০-২২ টন কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করলে এর কোনো প্রভাবই পরিবেশের ওপর পড়ে না। মূলত নদ-নদীর পানি দূষণের ফলেই জলজপ্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিদেশে ২০০ ও ১৩০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়ার চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। চীন, জাপান, তাইওয়ান কিংবা থাইলান্ডের মানুষ এর চেয়ে কম ওজনের কাঁকড়াই বেশি পছন্দ করছে। বাঁধাধরা কোনো নীতিমালা না থাকায় ভারত, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশ কাঁকড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিচ্ছে। শুধু রপ্তানির বাজারই নয়, বাংলাদেশ থেকে ছোট-বড় কাঁকড়া পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে অতি সহজেই সেগুলো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সম্ভাবনাময় কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি খাতটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিদেশে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হওয়ায় সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ উপক‚লবর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে এর চাষাবাদ চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ৫০-১২০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়ার চাহিদা ভালো। সেই চাহিদা সামনে রেখে বাংলাদেশের কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা, পাইকগাছা এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই কাঁকড়া ও কুঁচের খামার গড়ে তুলেছেন। সেখানে ৫০-১২০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া হিমায়িত করে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি করা হচ্ছে। কোনো কোনো চাষি এ ধরনের কাঁকড়া ও কুঁচে উৎপাদন করে স্বর্ণপদকও লাভ করেছেন। চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়ায় বেশি লাভ হচ্ছে বলে অনেক চাষি এদিকেই বেশি ঝুঁকছেন। এ খাতটি বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে খুব সহজেই দ্বিগুণ পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি এমন একটি খাত যাতে সরকারের কোনো আর্থিক প্রণোদনা, ব্যাংক ঋণ কিংবা অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে না। বরং উপক‚লবর্তী এলাকার লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষ কাঁকড়া চাষের সঙ্গে জড়িত হয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এটি এমন একটি পণ্য যার কোনো বাজার বাংলাদেশে নেই। সেই পণ্যটি বিদেশে রপ্তানি হয়ে উপার্জিত পুরো এক হাজার কোটি টাকাই দেশকে সমৃদ্ধ করছে।