কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া ভেড়ার বাচ্চা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু হাসপাতাল-সংলগ্ন মাঠ থেকে তোলা ছবি। ছবিটি ২০১৩ সালের শেষের দিকে তোলা l সংগৃহীতগবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজননে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ। গরু ও ছাগলের পর কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো ভেড়ার জন্ম দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি বেশির ভাগ মানুষের কাছে এখনো অজানা রয়ে গেলেও গত চার বছরে কৃত্রিমভাবে ১৮০টি ভেড়ির বাচ্চা প্রসব করানো হয়েছে। ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছিলেন গবেষকেরা।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে ভেড়ার উৎপাদন খামারিদের জন্য বড় সুখবর বলে মন্তব্য করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এই পদ্ধতি মাঠপর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে প্রয়োগ করা হলে দেশে ভেড়ার উৎপাদন বাড়বে। একই সঙ্গে মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গবাদিপশুর খামারিরাও এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।
লেপা রোস্কপি আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন (লেপআই পদ্ধতি নামে পরিচিত) পদ্ধতিতে দেশে ভেড়ির বাচ্চা প্রসব করানো হয়েছে। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আজিজুন্নেছা তাঁর গবেষণার অংশ হিসেবে ভেড়ির কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে প্রথমে কাজ করেন। ১২৮টি দেশীয় প্রজাতির ভেড়িতে লেপআই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন তিনি। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছেন তিনি। কৃত্রিম প্রজননের কাজটি করা হয়েছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক তালুকদার নূরুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, গবেষকদের সাফল্যের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে জানানো উচিত।
গবেষকেরা জানান, লেপআই পদ্ধতিতে প্রথমে ভেড়ির পেটের নিচের দিকে দুটি সূক্ষ্ম ছিদ্র করা হয়। ওই ছিদ্র দিয়ে দুটি পাইপ প্রবেশ করিয়ে প্রথমে জননাঙ্গ পরীক্ষা করা হয়। এরপর ভেড়ির জরায়ুতে ভেড়ার শুক্রাণু (তরল এই শুক্রাণু খামারিদের কাছে বীজ হিসেবেও পরিচিত) প্রয়োগ করা হয়। পরে ছিদ্র দুটিতে কখনো ক্লিপ লাগানো হয়, কখনো বা তা সেলাই করে দেওয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে তিন থেকে পাঁচ মিনিট লাগে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সার্জারি ও অবস্টেট্রিক্স বিভাগে ‘বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস’ ও ‘ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার’-এর অর্থায়নে একটি প্রকল্পের অধীনে এই গবেষণা করেন অধ্যাপক আজিজুন্নেছা। গবেষণায় তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক বেগম ফাতেমা জোহরা। গবেষণাটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাকৃবির সার্জারি ও অবস্টেট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক মো. গোলাম শাহি আলম (বর্তমানে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) ও অধ্যাপক ফরিদা ইয়াসমিন বারি।
গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক বাকৃবির অধ্যাপক ফরিদা ইয়াসমিন বারি বলেন, আজিজুন্নেছাই প্রথমবারের মতো লেপারোস্কপি পদ্ধতিতে ভেড়ির কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে সাফল্য পেয়েছেন।
গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকেরা বলেন, গরু, ছাগল ও ভেড়ির কৃত্রিম প্রজননে তিনটি পদ্ধতি আছে। এগুলো হচ্ছে ভেজাইনাল পদ্ধতি (জরায়ুর মুখে কৃত্রিম পদ্ধতিতে ভেড়ার ‘বীজ’ প্রয়োগ), ট্রান্সসার্ভাইক্যাল পদ্ধতি (জরায়ুর গ্রীবায় বা জরায়ুর মধ্যে কৃত্রিম পদ্ধতিতে ভেড়ার ‘বীজ’ প্রয়োগ) ও লেপরোস্কপি পদ্ধতি। ভেজাইনাল পদ্ধতিতে প্রজননে সাফল্যের হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ, ট্রান্সসার্ভাইক্যাল পদ্ধতিতে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ এবং লেপরোস্কপি পদ্ধতিতে সাফল্যের হার ৭০ শতাংশের বেশি। অবশ্য বাংলাদেশে মাঠপর্যায়ে ভেড়ির বাচ্চা উৎপাদনে এখন পর্যন্ত কোনো পদ্ধতিই প্রয়োগ করা হয়নি।
গবেষণকেরা বলেন, দেশে এখন প্রায় ৩০ লাখ ভেড়া রয়েছে। দেশের প্রায় সব জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভেড়া পালন করেন খামারিরা। তবে নোয়াখালী, কক্সবাজার, রাজশাহী, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাঙামাটি, বান্দরবান ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ভেড়ার খামার বেশি দেখা যায়। ভেড়ার গড় আয়ুষ্কাল আট থেকে নয় বছর। ছয় মাস বয়সী ভেড়ার মাংস খাবারের উপযোগী হয়।
গবেষক আজিজুন্নেছা বলেন, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করা দেশি জাতের ভেড়ার মধ্যে রোগবালাইয়ের হার বেশি। এ কারণে মাংস, চামড়া ও লোমের গুণগত মানও কমে যায়। অনেক খামারি ভেড়ির কৃত্রিম প্রজনন করতে চাইলেও মাঠপর্যায়ে তেমন সুবিধা না থাকায় এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ভেড়ির কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি যদি মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের উপযোগী হয়, তাহলে এটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অজয় কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, ছাগল ও গরুর কৃত্রিম প্রজননের খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। কারণ দেশে এ দুটি প্রাণীর সংখ্যা যথেষ্ট। উন্নত জাতের ভেড়া আমদানি করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনে গেলে ভালো হয়।