ফুল এক সময় শুধু মনের খোরাক জোগাত। এখন ফুল মনের সঙ্গে যুক্ত করছে অর্থনীতির অবদান। ফুল চাষ ও বিক্রি করে আজ মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছে। দেশের গ-ি পার হয়ে বাংলাদেশের ফুল এখন বিদেশেও যাচ্ছে। ফুলের বর্তমান বাজার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন -নিজস্ব প্রতিবেদক গোলাম রাব্বানী
‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে তবে একটিতে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী’। ক্ষুধা মেটানোর জন্য যেমন খাবার রয়েছে, তেমনই মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য ফুলের কোনো বিকল্প নেই। ফুলপিয়াসী নগরবাসীর প্রয়োজন মেটাতে গড়ে উঠেছে ফুলের বাজার।
ফুল ব্যবসায়ীরা বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনের ফুল অর্থনৈতিকবর্ধন ঘটাতেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ২০ লাখ মানুষের কাছে ৮০০ কোটি টাকা পৌঁছে দিচ্ছে ফুল। ফুল শুধু শোভাবর্ধন ও দর্শনীয় পণ্য হিসেবেই ব্যবহার হয় না। বরং এখন ফুল অর্থনৈতিক রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ফুল চাষ ও এর বিপণনের সঙ্গে দেশে প্রায় ২০ লাখ মানুষ জড়িত। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ফুল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার টন। ফুল বিক্রি করে আয় হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এর আগের ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫০ হাজার টন ফুল উৎপাদন হয়। ফুল বিক্রি থেকে আয় হয় ৭০০ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ফুল বিক্রির থেকে আয় বেড়েছে ১০০ কোটি টাকা। এভাবে প্রতিবছরই ফুল চাষের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বাড়ছে। সম্ভাবনাময় এ খাতকে আরও এগিয়ে নিতে সমন্বিত ফুলনীতি, ফুলের স্থায়ী বাজার এবং ফুল নিয়ে গবেষণার দাবি জানিয়েছেন ফুল ব্যবসায়ী ও চাষিরা। ফুলের বিপণন শহরকেন্দ্রিক বেশি। তবে এখন গ্রামাঞ্চলের ফুল বিকিকিনি হয়। করপোরেট দুনিয়ার প্রায় সব অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ফুল। রাজধানীতে ফার্মগেট ও শাহবাগ ফুলের সবচেয়ে বড় বাজার। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন বাজারেও ফুল বিক্রি হয়। ধানম-ি, গুলশান, বনানী, মতিঝিলসহ প্রায় সবখানেই রয়েছে ফুলের দোকান। ফুলের বড় বাজার নগর হলেও সারা দেশে ফুল বিক্রি হয়। গ্রামাঞ্চলের বিয়ে, জন্মদিন, ধর্মীয়সহ বিভিন্ন উৎসবে ফুলের ব্যবহার হচ্ছে। দেশের সব জেলা ও উপজেলা শহর পর্যায়ে স্থায়ী ফুলের বাজার রয়েছে। স্থানীয় বাজারে অন্তত দুয়েকটি দোকান গড়ে উঠেছে। ওই সব দোকানের ফুলের সমারোহ খুব বেশি থাকে না। তবে চাহিদা পাওয়া গেলে ওই সব দোকানি তা সরবরাহ করেন। এভাবে দেশের সর্বত্র ফুলের বাজার ছড়িয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু হয়। বর্তমানে খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি প্রায় দুই হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। দেশে গাডিওলাস, গোলাপ ও রজনীগন্ধা ফুলের চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। প্রতি হেক্টর জমিতে খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসলের তুলনায় ফুল চাষ বেশি লাভজনক। যশোর, ঝিনাইদহ, সাভার ও চুয়াডাঙ্গাসহ ২৪ জেলায় ১০ সহস্রাধিক হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। যার প্রায় ৭০ শতাংশ ফুল উৎপাদন হয় ফুলরাজ্য হিসেবে চিহ্নিত যশোরের গদখালী এলাকায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে এখনো পুরোপুরিভাবে স্বীকৃতি পায়নি ফুল। ফুল দ্রুত পচনশীল, বিধায় এগুলো রপ্তানিতে দ্রুত ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু ফুল রপ্তানিনির্ভর দেশ বা অঞ্চলে আলাদা বিমানবন্দর থাকলেও বাংলাদেশে এরূপ ব্যবস্থা নেই। আর ফুল সংরক্ষণের জন্য নেই কোনো আলাদা হিমাগার।
বাংলাদেশ ফুল উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি এম আহসানউল্লাহ বলেন, ফুল রপ্তানি করতে হলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে ফুল উৎপাদনের জায়গা হলে ভালো হয়। বিমানবন্দরে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল দরকার। এ খাতের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিরূপণে সাভার ও যশোরের ঝিকরগাছায় ফুল গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। এটি হলে টিস্যু কালচার, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার বিষয়গুলো নিশ্চিত হবে।
বিরাট সম্ভাবনাময় খাতটির প্রধান সমস্যা রপ্তানির প্রতিবন্ধকতা। বহুবার আবেদন-নিবেদন করে দীর্ঘদিনেও ফুল রপ্তানির প্রতিবন্ধকতা দূর করা যায়নি বলে জানালেন ফুলচাষি কল্যাণ সমিতি ও ফ্লাওয়ার সোসাইটির নেতৃবৃন্দ। ফুল রপ্তানির সরকারি নীতিমালার অভাবে বিদেশে ফুলকে সবজি হিসেবে বিক্রি করতে হচ্ছে। আর রপ্তানি পণ্য হিসেবে ফুলের সঙ্গে পান সংযুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ফুলের ব্যাপক কদর ও চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সুযোগকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। এ ছাড়া দেশের বাজারেও ফুলের চাহিদা অনেক। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে খামারবাড়ি ও শাহবাগ ফুল নিয়ে আসছেন আড়তদাররা। আর সেখান থেকেই রাজধানীসহ বিভিন্ন প্রান্তে বিপণন করা হচ্ছে।
“