রাণীনগর উপজেলার রাতোয়াল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়টি ১০৩ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে।
বিদ্যালয়টি রবীন্দ্র নিদর্শন এবং বাংলাদেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে তত্কালীন সময়ে একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিদ্যালয়টিতে ষষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় বিশ্বকবি শব্দটি।
বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৩শ ৮০জন শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণ করে। বিদ্যালয়ে মোট আটজন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী কর্মরত আছেন। বিদ্যালয়ে নতুন ও পুরাতন মিলে মোট সাতটি কক্ষে চলে পাঠদান কার্যক্রম।
বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৮৮৫ সালের শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কালীগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখাশোনার জন্য রাতোয়াল গ্রামে আসতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রজাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষার আলো ছাড়া প্রজাদের সার্বিক উন্নয়ন একেবারেই সম্ভব নয়। সে উপলব্ধি থেকেই সেই সময়ের কিছু পণ্ডিতদের সহায়তায় এই রাতোয়াল গ্রামে বিশ্বকবির নামে আদর্শ এই বিদ্যাপীঠের পথ চলা। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যানেজার শ্যামানন্দ গুহ কালিগ্রাম পরগনার এই মূল জমিদারি(পতিশর স্টেট) দেখাশোনা করতেন এবং তার ছেলে নিত্যানন্দ গুহ(নিতাই বাবু) দেখাশোনা করতেন(সাবস্টেট) এই এলাকা। তাদের সার্বিক সহযোগিতায় তত্কালীন রাতোয়াল গ্রামের আক্কাছ আলী পণ্ডিত, শমসের আলী আকন্দ, কফিল আলী আকন্দ এবং এরফান আলী আকন্দকে সঙ্গে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়। বিদ্যালয়টি তত্কালীন সময়ে আজিজুল্লাহ আকন্দের বৈঠকখানায় শুরু হলেও পরবর্তীতে রবীন্দ্র স্টেটের নিজস্ব সম্পত্তির উপড় মাটির কটি ঘর তৈরি করে ১৮৮৫ সালে(অনুমান) প্রাথমিকভাবে শিক্ষাদান শুরু হয়।
তখন হেড পণ্ডিত হিসেবে রাতোয়াল গ্রামের আক্কাছ আলীর উপর বিদ্যালয়টির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। পরবর্তীতে আরো অনেকেই বিদ্যালয়টির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়টি ১৯১৩ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। তবে বিশ্বকবির স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টিতে আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে অনেক পিছিয়ে।
আদর্শ এ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে এলাকার অনেকেই আজ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন বিভাগে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলছেন আর বিশ্বের মাঝে আলোকিত করেছেন এই অজপাড়া গ্রামের আদর্শ বিদ্যালয়টির নাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট) এর অধ্যাপক জুলু চৌধুরী, প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান ছিলেন বিসিআইসির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, পঞ্চম শ্রেণির গণিত বইয়ের লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ লুত্ফুজ জামান ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোখলেছুর রহমানসহ আরো অনেকেই ছিলেন এ আদর্শ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী।
বিশ্বকবিকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী রাতোয়াল গ্রামের শরফরাজ আলী আকন্দ(১শ) বলেন, বিশ্বকবি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর শেষবারের মতো যখন তার পতিসরের জমিদারি দেখতে আসেন তখন তিনি এ বিদ্যালয়টিতে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন। বিশ্বকবিকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার জন্য এই বিদ্যালয় থেকে তিনিসহ আরো অনেক ছাত্র পতিসরে পায়ে হেঁটে গিয়েছেন। বিশ্ব কবিকে দেখতে পতিসরে গেলে সেখানে আসা লোকজনকে যে খাবার খাওয়ানো হয়েছিল তার স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে রয়েছে বলে তিনি জানান।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. আকতার আহমেদ বলেন, আমি এই আদর্শ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম বলে গর্বিত। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হয়ে চেষ্টা করে যাব ঐতিহ্যবাহী আদর্শ বিদ্যাপীঠের সার্বিক উন্নয়ন করার জন্য।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা মো. শুকবর আলী জানান, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে, আমি এই ঐতিহ্যবাহী আদর্শ বিদ্যাপীঠের ছাত্র থেকে শিক্ষক হব। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।