ফুলবাগানের পাঠশালা। প্রকৃত অর্থে এটি কোন স্কুল নয়, স্কুলের মতোই ব্যতিক্রমধর্মী এক শিক্ষা কার্যক্রম। ব্যতিক্রমধর্মী তার কর্মসূচিও। বেশি দূরে নয়। যশোর শহর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটারের পথ। সেনানিবাস লাগোয়া উত্তর প্রান্তের খিতিবদিয়া গ্রাম। মনে হয় যশোর শহরেরই অংশ। এই গ্রামের গোলাম মোস্তফা মন্টু যিনি গ্রামের ছোট-বড় সবার কাছে মন্টু চাকলাদার বলে পরিচিত, তিনিই এই কাজটি করে সবার নজর কেড়েছেন।
কার মাথায় কখন কি চিন্তা আসে, আর সে চিন্তার ফসলে সমাজ কতখানি উপকৃত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা ভাবা যায় না। মন্টু চাকলাদার চাকরি করতেন অগ্রণী ব্যাংকে। যশোর বিমানবন্দর শাখা থেকে তিনি অবসর নেন ২০১১ সালে। চাকরি থেকে বিদায় নিয়ে টাকা-পয়সা যা পেয়েছেন আর ক্ষেত-খামার সহায়-সম্পদ যা আছে তাতে নতুন করে আয়ের পথে না গেলেও সংসার চলে যাবে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর আয়ের পথে হাটবেন না। তাহলে অখ- সময় পার হবে কিভাবে? হ্যাঁ সময় কাটানোর একটা ভালো পথ তিনি অল্প দিনের মধ্যে পেয়ে গেলেন। তিনি শিশুদের নিয়ে কিছু একটা করতে চাইলেন। শুরু করলেন তাদের পাঠদান। পাড়ার শিশুদের নিয়ে তাদের স্কুলের পড়া তৈরি করে দেয়ার কাজে হাত দিলেন।
তিনি মনে করেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক মূল্যবোধ ও শিল্প চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি সর্বোপরি মৌলবাদী আগ্রাসন থেকে জাতিকে ভবিষ্যতে একমাত্র শিশুরাই করতে পারে।
চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তাই সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কর্মকা-ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যুক্ত থাকার আকাঙ্ক্ষায় তিনি একটি ফুল ও ফলের বাগান এবং অলাভজনক মা ও শিশু শিক্ষার পাঠশালাটি গড়ে তোলেন। একদিকে ফুল বাগানে তার পাঠশালাটি চলে এবং শিশুদের তিনি ফুলের মতো মনে করেন। আর এ কারণেই তার পাঠশালার নাম হয়ে যায় ফুলবাগানের পাঠশালা। পৈতৃক সূত্রে তিনি সোয়া বিঘার মতো বাড়ির জমি পেয়েছেন। সেখানে তিনি আগে থেকে নানা জাতের গাছ-গাছালি লাগিয়েছিলেন। লাগিয়েছিলেন বিভিন্ন প্রজাতির ফুলও। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সেই বাগানে তিনি মাত্র দুটি শিশু নিয়ে তার কাজ শুরু করেন।
মন্টু চাকলাদার জানান, মা-বাবা তাদের কন্যাসন্তাটিকে দায় হিসেবে ভাবেন আর পুত্রসন্তানটিকে ভাবেন সম্পদ হিসেবে। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় দেখা যায়, পুত্রসন্তানটি যোগ্য হিসেবে গড়ে উঠতে না পারায় সেও দায় হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের পিছিয়ে পড়া ছেলেদের এই অবস্থাটা হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে তিনি কাজে পা বাড়ান।
যে দুটি শিশুকে নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিল। এর মধ্যে রাহাত চাকলাদার নামের শিশুটির ক্লাসে রোল নম্বর ছিল ৮৬ ও ৮৭ ছিল তার ভাই আহাদ চাকলাদারের রোল নম্বর। এদের স্কুলের পড়া তৈরি করতে সহযোগিতা করার সাফল্য হিসেবে অষ্টম শ্রেণীতে রাহাতের রোল নম্বর হয়েছে তিন ও আহাদের হয়েছে ছয়।
তিনি জানান, তার কাছে যদি শিশু দুটি লেখাপড়া না করতো তাহলে তারা অনেক আগেই ঝরে পড়ত। তাদের হতদরিদ্র বাবা স্বল্প আয়ের কাঠমিস্ত্রি মোরাদ চাকলাদারের পক্ষে সন্তান দুটির পেছনে লেখাপড়া বাবদ কোনক্রমেই টাকা-পয়সা খরচ করা সম্ভব হতো না।
মাত্র দুটি শিশু নিয়ে যে কার্যক্রম শুরু অল্প দিনের মধ্যে তার প্রতি মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠায় শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় নয়। এই কার্যক্রমে শিশুর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে হয়েছে ৩৫। এদের পড়ানোর জন্য ছয়জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এখানে স্কুলের পড়া শেখানো হয়। প্রথম দিকে কারো কাছ থেকে টাকা নেয় হতো না। এখন ১০০ থেকে ৩০০ টাকা করে নেয়া হয়।
তিনি জানান, প্রথম দিকে টাকা নেয়া হতো না বলে অভিভাবকরা ভাবতেন বিনা পয়সায় আর কি পড়াবে। এখন টাকা নেয়া হয় বলে তারাই ভাবছেন এখানে খুব ভালো পড়ানো হয়। তবে এই টাকা সবাই পরিশোধ করতে পারেন না। যারা টাকা দিতে পারে না তাদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার কোন নজির এখানে নেই।
শৈশব থেকে মন্টু চাকলাদার পারিবারিক উৎসাহে গ্রামে স্কুলে ও কলেজে সংস্কৃতি ও খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কর্মজীবনে কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন অগ্রণী ব্যাংকে। উদীচী, তীর্যক, শিল্পকলা একাডেমি ও জেলা ক্রীড়া সঙ্গে জড়িত আছেন।
সামাজিক অবস্থা বিশেষ করে তার গ্রামের সার্বিক চিত্র মন্টু চাকলাদারের আগে থেকে ছিল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করেছেন গ্রামের প্রায় হাজার মানুষের ৮০ শতাংশ ড্রাগ এডিক্টেড। আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা কম। জেলা শহর সংলগ্ন গ্রামটির এ হতাশাব্যঞ্জক চিত্র কেন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি যা পান তা হলো যশোর সেনানিবাস প্রতিষ্ঠার সময় ১৯টি মৌজার মানুষের জমাজমি বসতভিটা হুকুম দখল করে নেয়া হয়। তারা আশ্রয়চ্যুত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যার একটি বড় অংশ খিতিবদিয়া গ্রামে ঠাঁই নেয়। এ দিকে গ্রামটির মানুষ আশ্রয়চ্যুত না হলেও তাদের আবাদী জমির প্রায় সবই সেনানিবাসের ভেতর পড়ায় একমাত্র কৃষি পেশায় অভ্যস্থ মানুষগুলো কর্মহীন হয়ে পড়ে। সেই থেকে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তারা ছন্নছাড়া জীবনযাপন করতে থাকে। সেনানিবাসের ভেতর বিভিন্ন ধরনের দিন মজুরী করে তাদের হাভাত অবস্থায় দিন কাটতে থাকে। আর এ অবস্থার সুযোগ নেয় গ্রামের হাতে গোনা কিছু সম্পদশালী মানুষ। তাদের সম্পদ রক্ষা করার জন্য এ সব অভাবী মানুষগুলোকে তারা লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। তারা নিজেদের সম্পর্কে ভালো কিছু যাতে ভাবতে না পারে সেজন্য তাদের হাতে মাদক তুলে দিয়ে মাদকাসক্ত করে তোলে। এ কারণেই এই গ্রামের ১০০ বিঘা খাসজমি ভোগ দখলের চিন্তা তাদের মাথায় আসেনি। যুগ যুগ ধরে বিত্তবানরাই তা ভোগ দখল করছে। গ্রামে কোন প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল এবং কলেজ নেই। অথচ এই খাস জমিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হতে পারতো। এই জমিতে অন্তত একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় যশোরের ডেপুটি কমিশনারের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ গেছে, পাকিস্তান গেছে, স্বাধীন বাংলাদেরশর বয়স অর্ধ শতাব্দীকাল হতে চলল; কিন্তু বাস্তু হারানো সেই ক্ষত যেমন আর সেরে উঠল না তেমনি বিত্তবান তৈরি দাসানুদাসের সেই চরিত্রের পরিবর্তন হলো না।
তিনি সরকারের কাছে প্রশ্ন করে রাখেন নিচে পড়ে থাকা এ সব মানুষকে ওপরে তুলে আনার কি কোন প্রক্রিয়া আছে?
মন্টু চাকলাদারের স্ত্রী রাজিয়া মোস্তফা ডলি ও দুই ছেলে মোস্তফা আল মাহমুদ এবং মোস্তফা আল মাসুদ তার কাজে কখনো বিরক্ত হননি। বরং তারা তাকে উৎসাহিত করেছেন। মাহমুদ এঙ্পোর্ট-ইম্পোর্ট ব্যবসায়ী ও মাসুদ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক।
মন্টু চাকলাদার জানান, জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃতি, হানাহানি, নৈরাজ্য প্রভৃতির যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সেই বিকৃত মানসিকতা পরিবর্তনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ। অশিক্ষা কুশিক্ষা ও অদক্ষতার কারণে মাদকাসক্তি, ইভটিজিংসহ নানা থরণের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতির কারণে অভিভাবকদের আর্থিক সমস্যায় তারা প্রকৃত আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
মন্টু চাকলাদার জানান, পাঠশালাটি মূল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। মূল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাত্র। সকাল বিকেল ও রাত এই তিন সময় স্কুলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠশালার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়। সকাল ও সন্ধ্যায় লেখাপড়া, বিকেলে খেলাধুলা ও বাগান চর্চাসহ সংস্কৃতি চর্চা যেমন নাচ, গান, গজল, আবৃত্তি, গল্প বলা, নাটক, একক অভিনয় থিয়েটার, বিতর্ক এবং নিয়মিত চারুকলা ইত্যাদি বিষয় নিয়মিত চর্চা করা হয়। অভিনয় প্রতিযোগিতায় ফুলবাগানের পাঠশালার এক ছাত্রী প্রথম স্থান অধিকার করেছে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা অন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করে থাকে। এছাড়া শিশুদের কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়। মা ও অভিভাবকদের নিয়ে সন্তান পালনে ও শিক্ষায় বাবা-মা এবং অভিভাবকদের ভূমিকা প্রসঙ্গে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করা হয়। শিশুদের বহুমাত্রিক জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে একটি পাঠাগার স্থাপনের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। বয়স্কদের অক্ষর জ্ঞান দেয়ার বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। জাতীয় দিবসসমূহের গুরুত্ব শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরা এবং তা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করা হয়। অর্থাভাবে শিশুদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া রোধ করা এবং দরিদ্র পরিবারের শিশুদের উপযুক্ত শিক্ষাদান এবং বাবা-মা ও অভিভাবকদের শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়াই হচ্ছে এর মূল উদ্দেশ্য।