ভয়ের চরে আশার আলো

স্বর্ণদ্বীপে গড়ে উঠছে সেনাবাহিনীর বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

মাত্র পাঁচ বছর আগেও গল্পটা অন্যরকম ছিল। নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা জাহাজ্জ্যার চরে ছিল জলদস্যুদের আস্তানা। নৌ-যান আর আশপাশে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারীদের ওপর হামলা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। প্রায় আড়াই হাজার জলদস্যুর অবাধ বিচরণ ছিল এখানে। ভয়ের জনপদে পরিণত হয়েছিল চরটি। তবে এসব অতীতের গল্প। এখন ভয়ের চরটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে আশার আলো। এখানেই গড়ে উঠছে সেনাবাহিনীর জন্য বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। চরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্বর্ণদ্বীপ’।

 

জানা যায়, কোনো এককালে এখানে জাহাজডুবি হয়েছিল। এজন্য স্থানীয়রা চরের নাম দিয়েছিলেন ‘জাহাজ্জ্যার চর’। ২০১৩ সালে সরকার চরটিকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। চরটিকে নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সেনাবাহিনী।

 

বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে সেনাবাহিনী। এসব হচ্ছে- সেনা প্রশিক্ষণের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চর রক্ষা করতে বনায়ন ও আশেপাশে থাকা স্থানীয় জনগণের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন। এছাড়া রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।

 

নোয়াখালীর সুবর্ণচরের জহির ঘাট থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় স্বর্ণদ্বীপে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। নদীপথ ছাড়া চরে যাতায়াতের বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার এ চ্যালেঞ্জ থাকার পরেও দুর্বার গতিতে স্বর্ণদ্বীপকে গড়ে তোলার কাজ করছে সেনাবাহিনী। এখান থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার সেনা সদস্য উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।  সেনাবাহিনীর চলাচল ও বাসস্থান (এমঅ্যান্ডকিউ) পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মামুন অর রশীদ বলেন, স্বর্ণদ্বীপকে প্রস্তুত করা আমাদের কাছে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেছেন। সেনাবাহিনীর উত্কর্ষতা বাড়াতে চরটিকে বহুমাত্রিক প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। সরকারের দিকনির্দেশনা মেনে এখানে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

 

সেনাবাহিনী জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে দুর্গম এ দ্বীপে তাঁবুতে অবস্থানের মাধ্যমে সেনা সদস্যরা তাদের যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে অস্থায়ী ও স্থায়ী আবাসনের কাজ শুরু হয়। সেনাবাহিনী এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের যৌথ সহায়তায় এরইমধ্যে স্বর্ণদ্বীপে দুইটি সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করা হয়েছে। এসব শেল্টারে ২০ হাজার গ্যালন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এবং গ্রিন এনার্জির উত্স হিসেবে সোলার বিদ্যুত্ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্যোগের সময় প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারে আনুমানিক ৫শ’ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। এগুলো চরে বসবাসরত ও অবস্থানরত সবাই ব্যবহার করতে পারবে। গত বছরের মে মাসে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর সময় বাথান শ্রমিক ও জেলেসহ স্থানীয় জনগণ নবনির্মিত এ সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছিল। শিগগিরই আরো তিনটি সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করা হবে।

 

সেনাবাহিনী জানিয়েছে, চরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য দুইটি লেক খনন করা হয়েছে। সুপেয় পানির জন্য এক হাজার মিটার গভীর সৌরবিদ্যুত্ চালিত পাম্প খনন এবং বর্ষা মৌসুমে চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এদিকে স্বর্ণদ্বীপকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে সেনাবাহিনী। এজন্য ৭২ হাজার একর জায়গার স্বর্ণদ্বীপে বড় পরিসরে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এরইমধ্যে স্বর্ণদ্বীপে ছয় হাজার ঝাউ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে সিড বোম্বিংয়ের মাধ্যমে দুই টন কেওড়ার বীজ ছিটানো হয়েছে। এছাড়া ভিয়েতনাম থেকে আনা ডুয়ার্ফ প্রজাতির ১৫শ’ নারিকেল গাছের চারার সমন্বয়ে পাইলট প্রকল্প হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কারিগরি সহায়তায় আদর্শ নারিকেল বাগান করা হয়েছে। এ বাগানের সঙ্গে মাছের খামার ও সবজি চাষ করা হচ্ছে।

 

সেনাবাহিনী জানিয়েছে, স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য এরইমধ্যে স্থানীয় জনগণ ও সেনাবাহিনী ‘সমপ্রীতি’ নামে একটি সমবায় গঠন করেছে। চরের বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো-ছিটানো স্থানীয় জনগণের মহিষ, গরু ও ভেড়ার বাথানগুলো দ্বীপের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া ছোট পরিসরে স্বর্ণদ্বীপে একটি ডেইরি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এখানে বাথানগুলোতে পালিত মহিষ ও গরুর দুধ সংগ্রহ করে দুগ্ধজাত পণ্য উত্পাদিত হচ্ছে। এসবের পাশাপাশি দ্বীপে ভেড়া ও হাঁস পালনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।