দেশে যারা খেলনা তৈরি বা আমদানি করেন, তাদের যদি উপযুক্ত সহায়তা দেয়া যায়, তা হলে খেলনা নিয়ে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করা অসম্ভব কিছু নয়। সরকারি তদারকি, নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চল, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কছাড়, সহজ শর্তে ঋণ, আইনি সহায়তা, সম্ভব হলে দীর্ঘমেয়াদি কর অবকাশ দেয়া যায় কি না, সরকারের নীতিনির্ধারকদের তা ভাবতে হবে।
হোসাইন মুবারক
মনে পড়ে ছেলেবেলার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। তখন বছরে একবার বসত মেলা। গ্রামের প্রান্ত ঘেঁষে খোলা মাঠে। পাশাপাশি টানানো কিছু রঙিন শামিয়ানা। ওই লাল-সাদা বিশাল শামিয়ানাগুলোর নিচে থাকত সার্কাস, পুতুল নাচ ও যাত্রাগানের প্যান্ডেল। রকমারি মিষ্টিসহ সারি সারি মনিহারি দোকান। মেলার চারপাশে বাঁশির পুঁ-পাঁ শব্দ, খেলনাগাড়ির ভটরভটর আওয়াজ, শোনা যেত বহুদূর থেকে। চারদিকে উৎসবের আমেজ। মাইকে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা_ মেলা! মেলা!! মেলা!!!
সেই রঙের মেলায় শিশুরা যেত অভিভাবকের হাত ধরে। শুরুতেই বায়না খেলনা কেনার। শিশুদের হৃদয়ের সবটুকু অনুভূতি কাজ করত খেলনাসামগ্রীজুড়ে। সেই মেলা থেকেই শিশুদের খেলনার সঙ্গে গহিন সখ্য। এভাবে খেলনা গ্রামীণ সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। স্বল্প পয়সায় কেনা লাল বাঁশি, প্লাস্টিকের পুতুল, চামড়ার ঢোলওয়ালা খেলনাগাড়ি ছিল শিশুদের প্রথম পছন্দ। দেশের আনাচেকানাচে এ রকম মেলা ছিল অনেক।
এখন আর সেদিন নেই। বদলে গেছে মানুষ, বদলে গেছে এ যুগের শিশুরাও। ওরা এখন বৈচিত্র্যময় বিদেশি খেলনার ভক্ত। বড়রাও খুশি হয়ে প্রিয় শিশুদের উপহার দেন বিদেশি খেলনা।
এই বিদেশি খেলনা নিয়ে ‘আমাদের সময়’-এ ১১ জানুয়ারি একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদে চীনে তৈরি খেলনার বাংলাদেশি বিশাল বাজারের কথা বলা হয়েছে। সংবাদে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০০ খেলনা কারখানার কথা। এরমধ্যে প্রায় সব কারখানাই চীন থেকে আমদানি করা খুচরো পার্টস দিয়ে খেলনা সংযোজন করে। কিছু কারখানা সরাসরি খেলনা তৈরি করে। এসব কারখানার সঙ্গে আবার চীনের কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠানের আছে অংশীদারি ।
আরও তথ্য হচ্ছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার খেলনার বাজার। এর ৬৫ শতাংশ খেলনা আমদানি করা। বছরে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা এ খাতে ব্যয় হয়। আর নগরে যেসব খেলনা বিক্রি হয়, তার ৯০ শতাংশই বিদেশি। শুধু তাই নয়, বিদেশ থেকে আনা কাঁচামাল ও কিছু খেলনা যন্ত্রাংশের প্রায় ৯২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এতে দেশিপণ্যের দাম পড়ে দ্বিগুণ। তাই আমদানি করা খেলনা বিক্রি করে অধিক লাভ করলেও দেশিপণ্য পেরে ওঠে না। এ কারণে কোনো কোনো আমদানি করা খেলনা পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়।
সব সময় প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনীতিবিদরা নানা সম্ভাবনা খোঁজেন। দেশের অর্থনীতিকে কী করে আরো বেগবান করা যায়, এসব খাতে কী কী সংস্কার দরকার- এমন নানামুখী উন্নয়নচিন্তা রাষ্ট্রীয়পর্যায় থেকে ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত পর্যালোচনা করা হয়। তারপর শুরু হয় উন্নয়ন-পরিকল্পনা। এসব কারণে সরকারিখাত ও ব্যক্তিখাত দুই-ই এগিয়েছে।
শিশু খেলনার মতো একটি খাত, যার পরিধি বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং এখনও সোয়া ৩ হাজার কোটি টাকার বিদেশি খেলনা আমদানি করতে হয়- এ খাতকে কোনোভাবে অবহেলা করা যৌক্তিক নয়। এ রকম অনেক সম্ভাবনাময় খাত মিলেই তো জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
খেলনার যন্ত্রাংশ ও আনুষঙ্গিক পণ্য আমদানিতে যে বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে, তা আর্শ্চয হওয়ার মতো বিষয়। সব মিলে যদি ৯২ শতাংশ কর দাঁড়ায়, তাহলে সরাসরি আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে টিকবে কী করে? এখানে যারা অ্যাসেমবিংয়ের কারখানা করেছেন, তারা তো জনবল ব্যবহার করেন, এতে বেকারদের কর্মসংস্থান হয়। এতে বড় ব্যবধানের শুল্ক-বৈষম্য থাকা কতটা যৌক্তিক? একই অভিযোগ আগে মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকেও শোনা গেছে। তারাও নাকি শুল্ক-বৈষম্যের কারণে আমদানিকারকদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না।
যাক সে কথা, দেশিশিল্প বিকাশে যেখানে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়, আমদানিনির্ভরতা কমে, বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচে; সেখানে শুল্কহার সহনীয় মাত্রায় এনে দেশিশিল্প বিকাশে সহায়তা করা দরকার। এটা যে শিল্পের ক্ষেত্রেই হোক না কেন?
আমাদের খেলনাশিল্পের বাজার নিয়ে যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা একেবারে দেশি নিম্নমানের কোয়ালিটি দিয়ে এবং স্থানীয় অদক্ষ ব্যবস্থাপনার উৎপাদন দিয়ে সংকট মেটানো সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার দক্ষ ব্যবস্থাপনা। চীনের কিছু কোম্পানির সহায়তায় দেশে যে খেলনা তৈরি হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে রপ্তানিপণ্য হিসেবে আশার আলো দেখাতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি নীতিমালা এবং সেসঙ্গে ব্যাংকঋণ।
সংবাদে প্রকাশিত ট্রয় ম্যানুফাকচারারদের ভাষ্য, ছোট আকারের একটি খেলনা কারখানা করতে খরচ হবে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। আরও মানসম্মত কারখানা করলে খরচ হবে ৫০ কোটি টাকা। দেশে এ রকম বিনিয়োগকারীও আছেন। কিন্তু সরকারের নীতিমালা না থাকায় কেউ ঝুঁকি নিতে আসছেন না। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন সরকারের নীতিমালা।
শুধু খেলনা নয়, যে কোনো শিল্পবিকাশে নীতিমালা প্রয়োজন। নীতিমালা ছাড়া লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। খেলনাশিল্পের বিদেশি কাঁচামালের শুল্কহার কত হবে? শিল্পের মান নিয়ন্ত্রণে বিদেশি বিনিয়োগ বা অংশীদারি থাকলে তাদের সুযোগ-সুবিধা কী? শিল্পের শুরুতে কাঁচামাল আমদানি শুল্কমুক্ত হবে কি না? নতুন শিল্পকে শুল্কছাড় ও স্বল্পসুদে ব্যাংকঋণ দেয় যায় কি না- এসব সরকারের উচ্চপর্যায়ে পর্যালোচনা করা দরকার। তাহলেই সম্ভব আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে খেলনাকে রপ্তানিমুখী করা।
খেলনাপণ্যের বেশিরভাগই রাবার, স্টিল ও পাস্টিকের সমন্বয়ে তৈরি। এরমধ্যে পাস্টিক পণ্যে দেশ অনেক এগিয়েছে। আমাদের বেশ কটি কোম্পানি প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। কিন্তু আমাদের দেশে তৈরি কিছু খেলনা আছে, যার পাস্টিকের গুণমান ও রঙয়ের ব্যবহার খুবই নিম্ন। এগুলো যখন শিশুদের হাতে থাকে কিংবা দোকানে দেখা যায়, তখন অনেকেরই দৃষ্টিকটু লাগে।
এসব দেখলে আমাদের শিল্পদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নিম্নমানের এসব খেলনা প্রস্তুতকারীদের সহায়তা দিয়ে আরও উন্নত করার কথা ভাবতে হবে। সহায়তা পেলে এরাই একদিন দক্ষ খেলনা তৈরিকারক কোম্পানি হয়ে যেতে পারে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা জিনজিরার কথাই ধরা যাক। এখানে বিদেশি অনেক পণ্যের নাকি অতি সূক্ষ্ম করে নকল তৈরি করা হয়। তাদের এই গভীর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন অনেক। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। আমাদের দেশে তৈরি স্টিল ক্যামেরার বডি আমেরিকায় রপ্তানি হয়েছে, এমন সংবাদ পত্রিকায় দেখা গেছে প্রায় দেড় দশক আগে। এটা কিন্তু জিনজিরার ‘সেই’ ইঞ্জিনিয়াররাই সম্ভব করেছেন। এ রকম উদাহরণ হয়তো আরও আছে।
আমাদের খেলনাশিল্পের উন্নয়নে দেশের তরুণরাই বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে। যেসব খেলনা ব্যাটারিচালিত, রিমোর্ট দিয়ে চলে এগুলো দেশি তরুণ ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করতে পারবে।
দেশে যারা খেলনা তৈরি বা আমদানি করেন, তাদের যদি উপযুক্ত সহায়তা দেয়া যায়, তা হলে খেলনা নিয়ে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করা অসম্ভব কিছু নয়। সরকারি তদারকি, নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চল, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কছাড়, সহজ শর্তে ঋণ, আইনি সহায়তা, সম্ভব হলে দীর্ঘমেয়াদি কর অবকাশ দেয়া যায় কি না, সরকারের নীতিনির্ধারকদের তা ভাবতে হবে।
বর্তমান সরকার অনেক ক্ষেত্রে নীতিমালা তৈরি করেছে। অনেক শিল্প একটা পর্যায়ে চলে এসেছে। সেসঙ্গে প্রবৃদ্ধি অর্জনে এসব শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। খেলনাশিল্প নিয়ে যে সম্ভাবনা বিরাজ করছে তা নিয়ে সরকারের ভাবা দরকার। সেই সঙ্গে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বিষয়ে চিন্তা করা দরকার। খেলনাশিল্প হতে পারে আমাদের অর্থনীতির আরেকটি মাইলফলক।
হোসাইন মুবারক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট