বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। দেশের যে ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী। নারীরা প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কাজ করে চলেছে। নারীরা তাদের মেধা, সৃজনশীলতা ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে এবং অবদান রাখছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও রয়েছে সমান পদচারণ। বিভিন্ন সেক্টরে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলো তুলে ধরছেন_ মাসুমা রুমা
গণমাধ্যমে নারী
শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনে রয়েছে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। বর্তমানে গণমাধ্যমগুলোতে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। সফলতার সঙ্গে তারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে আসছে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবের ৬২ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক ফরিদা ইয়াসমিন বুলবুল। এর আগে তিনি তিনবার প্রেসক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও সর্বশেষ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় নেতৃত্ববিষয়ক প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন তিনি।
প্রথম চাকমা নারী আইনজীবী
এখন পর্যন্ত পাহাড়ে নারী আইনজীবীর সংখ্যা হাতেগোনা। আর চাকমা সম্প্রদায়ে নারী আইনজীবী হিসেবে দক্ষতা ও দুর্দান্ত প্রতাপে কাজ করছেন বিচারিক আদালতে এই দৃশ্য বিরল। সেই পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে সমারি চাকমা গত চার বছর ধরে বিচারিক আদালতে কাজ করছেন। এই নতুন বছরে তিনি সুপ্রিমকোর্ট বারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনিই চাকমা সম্প্রদায়ের প্রথম নারী আইনজীবী যিনি পেশাগত জায়গায় এই অর্জন করলেন।
সমারি চাকমা বলেন, ‘পাহাড়ের রাজনীতিটা ভিন্ন। নারী নির্যাতনের ঘটনা পাহাড়ে একরকম, পাহাড়ে অন্যরকম। এই ভিকটিমদের সহায়তা করার জন্য কেউ আইনি পেশায় কাজ করার কথা তেমন করে ভাবে না। আমি এই জায়গায় কাজ করতে চাই। একইসঙ্গে আমি মনে করি, পাহাড়ের নারীদের সামনে যদি উদাহরণ তৈরি করা যায় তাহলে আগামীতে নারীর জন্য পথ তৈরি হবে এবং আরও অনেকে আইনি পেশাসহ চ্যালেঞ্জিং জায়গায় কাজ করার উদ্যোম পাবেন।’ সমারি চাকমা হিল উইমেনস ফেডারেশনের একজন সক্রিয় নেত্রী ছিলেন। পরে তিনি নানা সামাজিক কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। সমারি রূপক চাকমা ট্রাস্টের মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে লেখাপড়া এগিয়ে নেয়ার কাজটিও করেন। সমারি চাকমা দীর্ঘদিন ধরে সহযোদ্ধা কল্পনা চাকমার অপহরণের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রেখেছেন। পাহাড়ের নারীদের নির্যাতনের ইতিহাস তা আজকের নয় এবং এই ধারাবাহিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সমারি চাকমা বরাবরই সরব।
সেরা শিক্ষক হিসেবে নারী
শিক্ষকতা পেশা অন্যান্য পেশার তুলনায় অধিক কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশা। বর্তমানে এ পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। নারীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ পেশায় দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কখনো তারা মেধা ও দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কারও পাচ্ছেন। বিশ্বের সেরা শিক্ষক নির্বাচনের জন্য ২০১৫ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ভারকি ফাউন্ডেশন ‘গ্লোবাল টিচার পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছে। এ বছর বিশ্বের ১৭৯টি দেশের ২০ হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে শীর্ষ ৫০ শিক্ষককে বাছাই করা হয়েছে। এই তালিকায় ১৬ জন নারীর মধ্যে আছে বাংলাদেশের শাহনাজ পারভীনের নাম। বগুড়ার শেরপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহনাজ পারভীন।
মনোনয়ন পাওয়া ৫০ জনের মধ্য থেকে এ বছর ১৯ মার্চ দুবাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়াতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন শাহনাজ। নাম ‘শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানোর পাশাপাশি বই-খাতা-কলম, পোশাক, ব্যাগ, টিফিন_ সবই দিচ্ছেন তিনি। শিক্ষকতার বাইরে লেখালেখির চর্চাও চালিয়ে যাচ্ছেন শাহনাজ। এ পর্যন্ত তার লেখা দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। শিশুদের জন্য লিখেছেন ছড়ার বই, ‘পাখির মুখে ফুলের হাসি’ (২০১৩), আর প্রাথমিক শিক্ষার হাল নিয়ে লেখা ‘অনুসন্ধান’ (২০১০)। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছোটদের জন্য ছড়া লিখে থাকেন।
প্রথম শিশু চিত্রী
তাকে শিশু বললে ভুল হবে। অঙ্কন দৃষ্টিভঙ্গি ও কালার সেন্স ইতোমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে বহু গুণীজনের। সে আফরাহ আনাম। দৃক গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হওয়া এক্সিবিশনে ১১০টি ছবি প্রদর্শিত হয়। সেখানে তার অনেক ছবি সেল হয়েছিল। সোলো এক্সিবিশন বাদেও গ্রুপ এক্সিবিশনেও অংশগ্রহণ করেছে আফরাহ। এ ছাড়া সে অনেক আর্ট কম্পিটিশনেও প্রথম হয়। বর্তমানে ভিকারুনি্নসায় ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া এ শিল্পী শিল্পচর্চার দীক্ষা নিয়েছে অনেক গুণীজনের কাছ থেকে। মাসুমা খান, রাশিয়ান কালচার সেন্টার, গ্রিল আর্ট একাডেমিতে চিত্রাঙ্কনের প্রশিক্ষণ নেয়। ভবিষ্যতে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের আর্টকে পরিচিত করাতে চায় ক্ষুদে এই বিখ্যাত শিশুশিল্পী।
দেশরক্ষায় অনবদ্য নারী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। শ্রম, মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে তারা। এরই মধ্যে দুঃসাহসী ও চ্যালেঞ্জিং কর্মকা-ে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে নারীরা।’ নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজনীনের এভারেস্ট জয়, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌসের প্রথম মহিলা ছত্রীসেনা হওয়ার গৌরব অর্জন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাঈমা হক এবং ফ্লাইং অফিসার তামান্না-ই-লুৎফীর প্রথম সামরিক বৈমানিক হওয়ার যোগ্যতা লাভ এই সফলতারই অংশ। প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি শপথ নেন ৮৭৯ নারী সৈনিক। এ ছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সামরিক নারী পাইলট হওয়ার সম্মান অর্জন করেছেন ক্যাপ্টেন নাজিয়া নুশরাত হোসেন এবং ক্যাপ্টেন শাহরিনা বিনতে আনোয়ার। এর ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ নতুন মাত্রা পায়।
সোনার বেড়ির শৃঙ্খল পদদলিত করে আর চার দেয়ালে বন্দি চাপাকান্নার পাহাড় ডিঙিয়ে নারী আজ উন্নয়নের সহযাত্রী। সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে স্বাধীনতার ৪৫ বছরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। অনেক বাধা তবুও লড়াই করে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। নারীর এই এগিয়ে যাওয়ার পথে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে প্রতিটি মানুষকে। তাহলেই একদিন এ দেশ হয়ে উঠবে, নারী-পুরুষের সুস্বমন্বিত বাংলাদেশ।