শিক্ষার অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

যেন ঈদের খুশি। নতুন বছরের প্রথম দিনেই বর্ণাঢ্য পাঠ্যপুস্তক উৎসবের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী ছাত্রছাত্রীর হাতে পেঁৗছে গেছে নতুন বই। চার রঙের বই হাতে পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা সবাই। নতুন বইয়ের গন্ধে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা। রঙিন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে চারদিকে এমন উৎসব আমেজে বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে রঙিন বই হাতে পেয়ে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা আনন্দের জোয়ারে ভাসছে।
পহেলা জানুয়ারি রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠ্যপুস্তক উৎসবের আয়োজন করে। পাঠ্যপুস্তক উৎসব-২০১৭ এর উদ্বোধন করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এ বই শিক্ষার্থীদের নতুন বছরের উপহার’। আগে বছরের প্রথম তিন মাসেও ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা বই হাতে পেত না। এখন বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীরা বই পেয়ে খুশি। শিক্ষা খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকারে বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা সরকারে আসার আগে দেখেছি ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণীর আগে এবং ৪২ শতাংশ নবম শ্রেণী পার না হয়েই ঝরে পড়ত। আমাদের এ পাঠ্যপুস্তক উৎসব বিশ্বব্যাপী অতুলনীয় উদাহরণ। বিশ্বের কোথাও এত বই বিতরণের নজির নেই।
২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করে আসছে সরকার। সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকাল থেকে বই বিতরণ শুরু হয়। সাত বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ২২৫ কোটি ৪৫ লাখ ১১ হাজার ৭৫০টি বই বিতরণ করেছে বর্তমান সরকার।
২০১৭ শিক্ষাবর্ষে চার কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ জন ছাত্রছাত্রীকে দেয়া হয়েছে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি পাঠ্যবই। প্রাক-প্রাথমিকে ৩২ লাখ ৬২ হাজার ৮৬৪ শিক্ষার্থীর ১ কোটি ৫ লাখ ৫ হাজার ৮৩২টি বই, প্রাথমিকে ২ কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ১২৯ শিক্ষার্থীর ১০ কোটি ৫২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৭টি বই, মাধ্যমিক ও এসএসসি ভোকেশনালে এক কোটি ২০ লাখ ৫৮ হাজার ২৬৮ শিক্ষার্থীর ১৭ কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৩৬৮টি বই, এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালে ২ লাখ ১০ হাজার ৭৭৫ জন শিক্ষার্থীর ৯ লাখ ২১ হাজার ১১০টি বই এবং ইবতেদায়ি ও দাখিলে ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার ২১ শিক্ষার্থীর ৫ কোটি ৭১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮৫টি বই।
এবারই প্রথম নিজেদের ভাষার পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ২৪ হাজার ৬৬১ শিশুর জন্য ৫১ হাজার ৭৮২টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। একইভাবে প্রথমবারের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯ হাজার ৭০০ ব্রেইল বই বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে ১ কোটি ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৭৬৮টি টিচিং ম্যাটেরিয়াল একই সঙ্গে বিতরণ করা হয়েছে।
গত সাত বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন শতভাগ শিশু স্কুলে যায়। বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে নতুন বই পায়। যুগোপযোগী আধুনিক কারিকুলামে তৈরি সারাদেশে একই প্রশ্নপত্রে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা দিয়ে তারা আলোকিত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এখন প্রতি বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, ১ নভেম্বর জেএসসি ও জেডিসি, পহেলা ফেব্রুয়ারি এসএসসি, পহেলা এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ। ভর্তি, ক্লাস শুরু, পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফল প্রকাশ সবই রুটিন অনুযায়ী হচ্ছে।
২০০৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই একটি যুগোপযোগী আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পর জনমত গ্রহণ করে পাস হয় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০। এটি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইতোমধ্যে এ নীতিমালার আলোকে পুরনো কারিকুলাম যুগোপযোগী করা, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা, গ্রেডিং পদ্ধতিতে পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ, নতুন বই প্রণয়ন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন, গুণগত শিক্ষক প্রশিক্ষণ, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করাসহ সরকার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলছে।
এখন পাঠ্যবইয়ে নৈতিক মূল্যবোধ, জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম, বাস্তব জীবনমুখী শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, চারু ও কারুকলা, ক্যারিয়ার এডুকেশন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইত্যাদি নতুন বিষয় হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। ধর্ম বইকে এখন ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা করা হয়েছে। সমাজ বিষয়ের বইয়ের নতুন সংস্করণ হয়েছে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়। বানানরীতিতে অনুসরণ করা হয়েছে বাংলা একাডেমির পদ্ধতি। বদলে গেছে সনাতন ধারার পাঠ ব্যবস্থা। মুখস্থ বিদ্যা বা নকল করে পাস করার দিন শেষ হতে চলেছে। এখন পড়তে হবে, বুঝতে হবে এবং তার প্রয়োগ দেখাতে হবে। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি এখন মাধ্যমিক পর্যায় ছাড়িয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্পর্শ করেছে।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে শিক্ষায় বিপ্লব এসেছে। শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন, ফর্ম পূরণ, পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরির আবেদনসহ যাবতীয় কাজ এখন অনলাইনে করা হয়। সারাদেশে প্রায় ২৫০০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন চালু করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। এসব প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়েছে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট মডেম ও স্পিকার। ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরির জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। দেশের বিদ্যুৎবিহীন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ছাত্রছাত্রীদের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে মোবাইল কম্পিউটার ল্যাব চালু করা হয়েছে।
কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষায় অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় শতভাগ ভর্তি এবং ছাত্রছাত্রী সংখ্যা সমতা অর্জনের কথা বলা হয়েছিল। বাংলাদেশ সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রাথমিকের সাথে মাধ্যমিক স্তরেও ছাত্রছাত্রী সংখ্যাসমতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষার প্রসার, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল উন্নয়নসহ নানা অগ্রগতি সাধনের পাশাপাশি সরকার শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকদের মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় টানার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাধারণ শিক্ষায় পাস করে শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি হচ্ছে বিধায় সরকার জীবনমুখী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে কাজ করছে। সর্বোপরি সরকারিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুষ্টিকর খাবর সরবরাহ করায় একদিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, অন্যদিকে সুস্থ জাতি গঠনে ভূমিকা রাখছে।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)