চানন্দীর শিম চাষি বিউটি বেগম এখন সকাল বিকাল দুই বেলা ফলন তোলেন। একবেলা প্রতিবেশীদের নিয়ে শিমের বিচি বের করেন। গত কয়েক বছর এই মৌসুমটা শিম নিয়েই ব্যস্ত থাকেন বিউটি। এখন আর তার কোনো অভাব নেই। এখন শুধু ছোট মেয়েকে বিএ পাস করানো আর একটা মুরগীর ফার্ম করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিকল্পনাই তাকে তাড়া করে ফেরে। শিম চাষ করে প্রতিবছরই তার আয় বাড়ছে। আরও এক শিম চাষি জয়নব বিবির ভাগ্যও শিমে বদলেছে বলে জানালেন তিনি। এক ছেলেকে তিনি গতবছর বিদেশ পাঠিয়েছেন। অসুস্থ স্বামীর চিকিত্সাও করাচ্ছেন।
শুধু বিউটি আর জয়নব নয় নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চানন্দী ও নলের চর ইউনিয়নের পাঁচ হাজার নারী শিম চাষ করে আর্থিকভাবে যথেষ্ট লাভবান হয়েছেন। প্রতি মৌসুমে প্রত্যেকে এক থেকে দেড় লাখ টাকার শিম বিক্রি করেন। বিস্তীর্ণ এই চর এলাকায় লবণাক্ততার জন্য বিশেষ ‘সার্জন’ পদ্ধতিতে শিম চাষ যেমন নারী কৃষকদের ভাগ্য বদলেছে তেমনই হাজারও নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। সম্প্রতি হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ এলাকা ঘুরে দেখা গেল, এই নারী চাষিদের চাষ করা শিম ও শিমের বিচি যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, খুলনাসহ সমগ্র দেশে। সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তা জানান, গতবছর উক্ত এলাকায় প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা শিম বিক্রি হয় প্রায় ৬ কোটি টাকায়। এবছরও এমনটি হবে বলে আশা করছেন তারা। এবছর দেড় একর জমিতে শিম চাষ করেন বিউটি। চলতি মৌসুমে এরই মধ্যে বিউটি ৪০ হাজার টাকার শিম আর শিমের বিচি বিক্রি করে ফেলেছেন। মার্চ মাস পর্যন্ত তার শিম বাজারে যাবে বলে জানান। স্বামী কামরুজ্জামান মানিক তাকে এ কাজে সাহায্য করেন। মাঝে মধ্যে সহকারীর সাহায্য নিলেও বেশির ভাগ কাজ, যেমন জমিতে বীজবপন, সার দেয়া, সেচের জন্য প্রতিদিন ৫০ বালতি পানি আনা- ইত্যাদি কাজ তিনি নিজেই করেন। কারণ সহকারীকে টাকা না দিয়ে সেই টাকা জমিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে চান তিনি। ঋণ পরিশোধ করলে আবার ঋণ পাওয়া যাবে। সামনের মৌসুমের জন্য আবার তৈরি হতে হবে। কিভাবে শিম চাষ শুরু করেন- প্রশ্ন করলে বিউটি বেগম বলেন, ২০০১ সালে এখানে এসে একদিকে জলদস্যুদের নির্যাতন, অন্য দিকে অভাব- সব মিলিয়ে অনেক কষ্টে ছিলেন তারা। ২০১০ সালে তারা দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার তিন দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারপর ঋণ নিয়ে শুরু করেন শিম চাষ। প্রথমে ১০ হাজার আর এবছর ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি।
নলের চরের শিমচাষি বিলকিস বেগম বলেন, পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শিম চাষ শুরু করেন তিনি। এখন তার ঋণ ৪০ হাজার টাকা। এই মৌসুমে ৩৫ হাজার টাকার শিম তিনি ইতিমধ্যে বিক্রি করে ফেলেছেন। বিলকিস জানান, ‘সার্জন’ পদ্ধতিতে চাষাবাদে তার খরচ হয়েছে মোট বিক্রির এক-তৃতীয়াংশ। কি এই সার্জন চাষ পদ্ধতি- প্রশ্ন করলে এলাকার কৃষিবিদ আতিকুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, এলাকার পানি লবণাক্ত, তাই বৃষ্টির মিষ্টি পানি ধরে রাখতে জমির মধ্যে মাটি কেটে নিয়ে দুইপাশ উঁচু করতে হয়। মাঝে পানি জমে থাকে। আগস্ট মাসে এই পানি দিয়ে শিম চাষ শুরু হয়। এই পানি দিয়েই শিম চাষ সম্পূর্ণভাবে করা যায়। দুই পাশের মাটিতে বোনা হয় শিম আর মাঝের পানিতে মাছ চাষ করা হয়। মাটি কেটে করা হয় বলে একে ‘সার্জন পদ্ধতি’ বলা হয়। গত বছর এলাকার ৫ হাজার হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়। আর উত্পাদিত ফসল প্রায় ৬ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। প্রতি মৌসুমে প্রত্যেক চাষি এক থেকে দেড় লাখ টাকার শিম বিক্রি করেন। তিনি বলেন, এলাকার চাষিরা আগাম ফলন ৭০/৮০ টাকা কেজি দরে এবং বিচি ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। ভরা মৌসুমে কেজি প্রতি শিম ৩৫/৪০ টাকা এবং বিচি ৭০/৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত্ না থাকায় হিমায়িত ব্যবস্থার অভাব, সেচের সমস্যা প্রভৃতি বাধা না থাকলে অল্প সময়ে শিমের ফলন দ্বিগুণ করা সম্ভব বলে তিনি জানান। আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোঃ রফিকুল আলম বলেন, পল্লীকর্ম সাহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) আর্থিক সহায়তায় তারা এই সকল চাষিকে ঋণ ও প্রশিক্ষণ দেন। তিনি জানান, এই এলাকায় কোনো সরকারি বেসরকারি ব্যাংক বা অন্য কোনো বেসরকারি আর্থিক সহায়তা সংস্থার কার্যক্রম নেই। নেই ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। সরকারের সাথে সমন্বয় করে নারীদের দেড় একর খাস জমি দেয়া হয়। এবছর মোট ৫ হাজার নারী চাষিকে ৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। মোঃ রফিকুল আলম বলেন, উপকূলীয় জেলা ভোলা থেকে লবণ সহিষ্ণু শিমের বীজ আনা হয়। চাষের কাজে, ফসল তুলতে এমনকি শিম থেকে বিচি বের করতে পুরুষের প্রয়োজন হয় না। আশেপাশের দরিদ্র নারীরাই এই কাজ করে অর্থ উপার্জন করছেন। পিকেএসএফ-এর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, কৃষি ও লাইভস্টক ইউনিটের আওতায় সারা দেশে পিকেএসএফ-এর ঋণের ৪০ শতাংশ প্রদান করা হয় যার পরিমাণ ১২ শত কোটি টাকা। এই নারী চাষিরা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে ভাল সাফল্য অর্জন করলে বৃহত্তরভাবে এই কার্যক্রম শুরু হয়।