একযুগ আগেও বরেন্দ্র অঞ্চল মরুভূমির ন্যায় খাঁ খাঁ করত। চোখে পড়তো ধু ধু পতিত মাঠ। ছায়া বা সবুজের ছোঁয়া ছিলনা রুক্ষ লালমাটি পানির অভাবে ফসলেরমাঠ ফেটে যেত। সেই বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে কৃষি বিপ্লব ঘটেছে। সব ধরনের ফসলের চাষ হচ্ছে বরেন্দ্রের এই অঞ্চলে। ফুল, ফল, শাক-সবজি, ধান, গম, ভুট্টা, মরিচ, সরিষা, ধনিয়া, মসুর, মুগডাল, ছোলা, মাষকালাই, টমেটোসহ নানাবিধ ফসলের সমারহ ঘটেছে বরেন্দ্র অঞ্চলে। অথচ গোদাগাড়ীর মানুষ ধান ছাড়া কোন ফসল চাষ করতেন না বা অন্য ফসলের চাষ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। এর কারণ হিসেবে জানা যায় বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ছিল না গভীর নলকূপ। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে তারা একটি মাত্র ফসল ধান চাষ করতেন। বৃষ্টির পানি যদি পরিমাণ মতো হত তাহলে ফসল ঘরে তুলতে পারতেন কৃষকরা। অন্যথায় মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতেন। সময়ের বিবর্তনে গোদাগাড়ী অঞ্চলে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপ স্থাপন, আশির্বাদ হয়ে আসে এই অঞ্চলের কৃষিতে ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে।
সেচের পানি পাওয়ায় কৃষকরা বিভিন্ন কৃষি চাষে আগ্রহী হন এবং কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের অক্লান্ত পরিশ্রমে বরেন্দ্র অঞ্চল সবুজে ভরে উঠতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় এখন ফলের মধ্যে পেয়ারা, আম, কাঁঠাল, মালটা, বড়ই, কলা, কামরাঙা, স্ট্রব্রেরি, লিচু ও ড্রাগন। ফুলের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গাঁদা, রজনীগন্ধা, জার্বেরা, বিভিন্ন রঙের গ্লাডিওলার্স ও বিভিন্ন রঙের জবা ও গোলাপ। সবজির মধ্যে রয়েছে লাউ, কুমড়া, মিষ্টি কমড়া, ফুলকপি, বেগুন, বাঁধাকপি, সিম, পটল, আলু, খিরা, শসা, পেঁপে। শাক এর মধ্যে রয়েছে লাল শাক, পুঁইশাক, সরিষা শাক, পাট শাক, কলমি শাক, পালং শাক ও লোটাস শাক। এছাড়া এই মাঠে রসুন ও পেঁয়াজের ব্যাপক চাষ হচ্ছে।
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কাঁকনহাট অফিসের প্রকৌশলী মোস্তফিজুর রহামন বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং কৃষির প্রসার ঘটানোর জন্য সাতশ’ ঊনপঞ্চাশটি গভীর নলকূপ ও পাঁচ হাজার পাঁচশ অ-গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়াও বৃষ্টির সংরক্ষণে বিভিন্ন খাড়িতে ক্রোস ড্যাম নির্মাণ ও পুকুর সংস্কার অব্যাহত রেখেছেন বলে তিনি জানান। এছাড়াও বিদ্যুতের ওপর চাপ কমানোর জন্য গোদাগাড়ীতে সৌর প্লান্টের মাধ্যমে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি সেচ দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
গোদাগাড়ী উপজেলা দেওয়াপাড়া বস্নকের উপসহকারী কৃষি অফিসার শহিদুল আলম টিপু বলেন গতানুগতিক ফসল থেকে বরেন্দ্রর কৃষকদের ভিন্ন ফসলে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ফুল, ফল ও অন্যান্য ফসলের প্রদর্শনী অব্যাহত রেখেছেন। এই প্রদর্শনের ফলে কৃষকরা ফুল, ফল এবং অন্যান্য ফসল চাষে আগ্রহী হয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন গোদাগাড়ী কৃষি অধিদপ্তর অক্লান্ত পরিশ্রম করে বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব ও ভিন্নতা নিয়ে এসেছেন।
সুন্দরপুর গ্রামের আরেক কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন বছরজুড়ে জমিতে ফসল চাষ করায় তার পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। আর এই সচ্ছলতার কারণে তিনি তার সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারছেন। অথচ তার বাবা এবং দাদাদের সময়ে কৃষির ওপর নির্ভর করে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেয়াই ছিল অনেক কষ্টের বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গোদাগাড়ী উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন বরেন্দ্র অঞ্চলে গবাদি পশু ও পাখি পালন পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেরা, হাঁস, মুরগি ও অন্যান্য পশু পাখি পালন হচ্ছে। কৃষকরা নিজের পালনকৃত গবাদি পশুপাখি থেকে মাংস, দুধ ও ডিম সংগ্রহ করে খেয়ে পুষ্টির চাহিদা পূরণসহ প্রচুর অর্থ আয় করছেন বলে তিনি জানান।
এতে তাদের স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশসহ রোগ বালাই কম এবং অর্থের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। শুধু মাত্র গোদাগাড়ীতে সাড়ে তিন লাখ হাঁস মুরগি এবং সাড়ে চার লাখ গবাদি পশু পালন হচ্ছে বলে তিনি জানান।
কৃষিতে বৈচিত্র্য আসলেও এবং সবুজের সমারোহ ঘটলেও বিলিন হতে বসেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তালগাছ।
সেইসঙ্গে ইটভাটার মালিকগণ অর্থের লোভ দেখিয়ে জমির উর্বর মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছেন ইট তৈরি করার জন্য। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। সেইসঙ্গে বরেন্দ্র অঞ্চল হারাচ্ছে তার উঁচু নিচু ছোট ছোট টিলার ঐতিহ্য। বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে মাটি কেটে সমান এবং তালগাছ কাটা থেকে বিরত রাখার জন্য প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান বিশিষ্ট জনেরা।