পাটের ব্যবহার বাড়াতে সরকারের সদিচ্ছার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে অনেক আগেই। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন ও করপোরেশনগুলো পাটের ব্যবহার বৃদ্ধির এ উদ্যোগের সঙ্গে একমত হয়ে জানিয়েছে, এর ফলে শিগগিরই ফিরবে পাটের সুদিন। আর দেশে যে পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়, সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আরও বেশি হারে পাটের ব্যবহার বাড়ানো উচিত। সরকারের পক্ষ থেকে আরও ১১টি পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট ১৭টি পণ্যের মোড়কীকরণে বাধ্যতামূলক হলো পাটের ব্যবহার। সম্প্রতি ভারতে পাটপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপের পর সরকারের এ উদ্যোগ যথার্থ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) নেতারা। বাংলাদেশের পাটপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ দুঃখজনক বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পাটপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ দুঃখজনক। ভারত বাংলাদেশকে তামাক ও মদ ছাড়া সব পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ডিউটি ও কোটা ফ্রি সুবিধা প্রদান করছে। অথচ পাটপণ্য রফতানির ওপর অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। অনেক পণ্য রফতানির ওপর সাড়ে ১২ শতাংশ হারে কাউন্টার ভেলিং শুল্ক নিচ্ছে। এতে বাংলাদেশে তৈরি পণ্য ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে এরই মধ্যে আলোচনায় তুলে ধরেছে। আবারও বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্ষেত্রে সব বাধা দূর করতে আন্তরিক হবে। ভারতের এমন উদ্যোগের পর সরকারের নতুন করে আরও ১১টি পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সচিব আবদুুল বারিক খান আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ বাস্তবায়নে সরকার যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন অসাধু চক্র আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চালের বাজারে শতভাগ পাটের বস্তায় চাল মোড়কজাত করা হলেও এজন্য যে পরিমাণ পাটের বস্তা প্রয়োজন, তাতে আমাদের গুদামে বস্তা থাকার কথা নয়। কিন্তু গুদামের প্রচুর বস্তা পড়ে আছে। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ধারণা করা হয়েছিল, সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশের বাজারে পাটের বস্তা সরবরাহ করা হচ্ছে। এ আশঙ্কার পর নতুন করে আরও ১১টি পণ্য যোগ হওয়ায় অসাধু চক্রটি খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের পাটপণ্য রফতানিতে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপের পর পাটের বাজারে ধসের সম্ভাবনা করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন করে ১১ পণ্য যুক্ত হওয়ায় এখন সেই আশঙ্কা কেটে গেছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে আরও দুইটি পণ্য যুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। এগুলো হচ্ছে পোলট্রি ফিড ও ফিশ ফিড মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। আশা করা যায়, সরকার পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করবে।
‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ এর জন্য আইনের অধীনে গঠিত ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা-২০১৩’ এর তফসিলে ১১টি পণ্য যুক্ত করে গেল ২১ জানুয়ারি গেজেট জারি করা হয়েছে। এর আগে ১৮ জানুয়ারি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়েছিল। পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা নতুন পণ্যের মধ্যে রয়েছে মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা ও তুষ-খুদ-কুঁড়া।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাসিমা বেগম বলেন, নতুন পণ্যগুলো পাটের মোড়কীকরণ করতে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তারপরও যারা এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে না, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রথম পর্যায়ে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদক ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রুহুল আমীন বলেন, এ সিদ্ধান্তে আমরা সরকারকে সুধাবাদ জানাই। তবে এটি বাস্তবায়নে সরকারের প্রচারণা চালানো খুবই জরুরি। আমাদের পক্ষ থেকেও প্রচারণা থাকবে।
মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ পুরোপুরি বাস্তবায়নে বছরে প্রায় ৭০ কোটি পাটের বস্তা প্রয়োজন। সে হিসাবে প্রতি মাসে ৫ কোটি ২৫ লাখ ব্যাগ লাগবে। বিভিন্ন পরিমাণের ৭০ কোটি বস্তা তৈরি করতে বছরে ৬০ থেকে ৬৫ লাখ বেল কাঁচাপাটের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের বার্ষিক উৎপাদন আছে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ বেল।
পাটের ব্যবহার যে প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তা বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদনে স্পষ্ট। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৪৭ কোটি ২৫ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা, যা রফতানি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। একইসঙ্গে গেল ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের তুলনায় রফতানি আয় ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মেয়াদে কাঁচা পাট রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ কোটি ৫৪ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। এ সময় কাঁচা পাট রফতানিতে আয় হয়েছে ১০ কোটি ৩২ লাখ ৪০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। একইসঙ্গে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ খাতের আয় ৩৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। গেল ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে কাঁচা পাট রফতানিতে আয় হয়েছিল ৭ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার।