বাংলাদেশের কৃষি : সম্ভাবনাময় বড় বাজার

লেখক : এমকে দোলন বিশ্বাস, সাংবাদিক
বাংলাদেশের কৃষি খাতটি অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনাময় বাজারের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও কৃষিজাত পণ্য রফতানির বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসেবে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি বিশ্ববাজারে প্রবেশের বড় সম্ভাবনাও বিদ্যমান। কৃষি এখনও দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ মানুষই জীবন-জীবিকা ও কর্মসংস্থান এর জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই কৃষিভিক্তিক শিল্পে স্বল্পমাত্রার সঞ্চালনা ও প্রেষণাই আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে যেমন পারে। তেমনই গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকাও রাখতে পারে।

মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন তথা দারিদ্র্যবিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষিশিল্পের উন্নয়ন এবং এ খাতকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার জন্য কৃষি খাতের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার অর্জন করতে পারে। তবে ২০০৮ সাল থেকে বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দ তেমন বাড়েনি, বরং মোট বাজেটে তা শতকরা হারে ক্রমাগত কমছে। জাতীয় বাজেটে মোট ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু কৃষি খাতে তা প্রতি বছর ক্রমাগতভাবে কমছে।

খাদ্য প্রক্রিয়াজাত উপ-খাত : এদেশের শিল্পখাতের মধ্যে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প অন্যতম প্রধান এবং সম্ভাবনাময় খাত। যা কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজন ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারছে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প দেশের প্রস্তুতকৃত খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ২২ ভাগের চাইতেও বেশি এবং এই উপ-খাত ২০ ভাগ শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান করছে। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি) সব খাদ্য প্রক্রিয়াজাত এন্টারপ্রাইজ এর অবদান ২ ভাগ। দেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প প্রকৃতিগতভাবেই আকার, প্রযুক্তি, পণ্যের গুণগতমান, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বিপণন এবং বণ্টনের ভিত্তিতে বহুমুখী। এই খাতে প্রাথমিকভবে মূলত: ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পই বেশি এবং স্থানীয় উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণের সম্ভাবনা, মূল্য সংযোজন এবং রপ্তানির সঙ্গে সংযুক্ত। দেশে প্রায় ৭০০ প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য প্রস্তুতকারী শিল্প রয়েছে, যার মধ্যে গৃহে প্রস্তুতকৃত পণ্যও আছে এবং এর মধ্যে অন্তত ৩০টি শিল্প কারখানা। যার মধ্যে রয়েছে কনফেকশনারি, ফলমূল ও শাকসবজি, সিরিয়াল, ডেইরি বা দুগ্ধজাত, কার্বনেটেড এবং নন কার্বনেটেড জুস, কোমল পানীয় এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে এখানে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বিপুল অভ্যন্তরীণ বাজার। এই সম্ভাবনা বরং আরও বৃদ্ধি পাবে যদি আমাদের সীমানা সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলের জনগণের একই ধরনের খাদ্যভ্যাস এবং সংস্কৃতিকে বিবেচনায় রাখা হয়।

খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ক্ষেত্রে এখনও রয়েছে যথাযথ প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব। এই শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা যদি সহযোগিতা, অংশীদারিত্ব এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘ভড়ৎধিৎফ ধহফ নধপশধিৎফ লিংকেজ স্থাপন’ করা যায়। সামপ্রতিক বছরগুলোতে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং বিকল্প প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বহু ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের উৎপাদন লক্ষ্যণীয়। কেবলমাত্র নতুন পণ্যের উন্নয়নই নয় বরং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, গুণগতমানের উন্নয়ন, বায়োসেপ্টি এবং প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং সেই সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বিপণন জোরদার করার পাশাপাশি উৎপাদন পদ্ধতির উপরেও জোর দেয়া হয়েছে।

খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কৃষি উৎপাদনের উপরে বহুলাংশে নির্ভরলশীল যেহেতু তার কাঁচামাল মূলত কৃষিজাত পণ্য। এ কারণে এই শিল্পকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ এর মোকাবিলা করতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা এবং মৌসুমভিত্তিক ফসল উৎপাদন। প্রতিবন্ধকতা থাকার সত্ত্বেও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের রয়েছে সর্বাধিক সম্ভবনা। এই সম্ভবনাকে সম্পূর্ণ রূপে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন ঝঁংঃধরহবফ ফসল উৎপাদন, মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশের বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং রপ্তানির ভিত্তিতে নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে এসব থেকে পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ এবং এই সেক্টরের উন্নয়ন ঘটতে পারে।

বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে- কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মনে করছেন আগামী ১২-১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা নিজেদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ফসলের জিন আবিষ্কার করবে যা দ্বারা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে একই সঙ্গে মানুষের চাহিদা অনুসারে ফসলের গুণগত পরিবর্তন ঘটবে। জিন আবিষ্কারের অগ্রগতি আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। পাটের জিন ও ফসলের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকের জিনম আবিষ্কার সেই অগ্রগতিরই চিহ্ন বহন করে। এরই ধারাবাহিকতা হতে লবণসহিষ্ণু জিন আবিষ্কার সম্ভব হলে শুধু বাংলাদেশের কৃষিতে নয়, ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বিশ্ব কৃষিতে।

বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ লবণাক্ত জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এ থেকে যে অতিরিক্ত ফসল ফলবে তার পুরোটাই বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে, যা থেকে দেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। এবং লবণসহিষ্ণু জিনের পেটেন্ট স্বত্ব নিয়ন্ত্রণ করে সমগ্র বিশ্বের কৃষিতে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু উন্নত জাত রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক শষ্য ও বীজ দ্বারা বাজার দখল করা সম্ভব হবে। এভাবে অন্যান্য ফসলের জিন আবিষ্কার করে এবং তা যথাপোযুক্ত ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে আমাদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন ফসলের পেটেন্ট স্বত্ব নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য আমাদের কৃষিতে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে।

প্রতিটি কৃষক দেশের তৈরি বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের ফসল ও বীজ উৎপাদনের দক্ষতার পাশাপাশি খরচ কমাতে সক্ষম হবে। প্রতিটি কৃষকের হাতে নিজেদের তৈরি উন্নত জাতের দেশি বীজ থাকবে ফলে বীজ বা প্রযুক্তির জন্য কারো ওপর নির্ভর করতে হবে না। বাংলাদেশের কৃষিতে একক বা ক্ষুদ্র কৃষকের স্থলে যৌথ বা সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হওয়া বৃহৎ কৃষকের সৃষ্টি হবে। ফলে তারা যৌথভাবে একটি এলাকার কৃষির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে এবং যার অংশীদার হবে তারা নিজেরা। তারা নিজেরাই নিজেদের ফসলের বীজ, উন্নত জাতের মাছের বীজ ও মাছ উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বিক্রি করতে পারবে। তাদের নিজেদের আয় হতে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা তারা নিজেরাই আবার পোলট্রি, গবাদি বা দুগ্ধজাত খামার করে নিজেদের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন পুষ্টি চাহিদা মেটাবে অন্যদিকে অতিরিক্ত উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। কৃষকরা দেশে তৈরি পাওয়ার ট্রিলার, ধান মাড়াই যন্ত্র বা দানা ফসল মাড়াই যন্ত্র, আগাছা নাশকযন্ত্র, বীজবপন যন্ত্র, ফসলকাটা ও শ্রেণী বিন্যাসকরণ যন্ত্র, মূল জাতীয় ফসল মাটি থেকে উত্তোলন যন্ত্র, উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন সেচযন্ত্র, ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি শ্রমিকের চাহিদা ও খরচ দুটোই কমাতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে যা দ্বারা অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।

পর্যায়ক্রমে কৃষিতে জৈব চাষ পদ্ধতির বিকাশ ঘটবে। ফলে আমাদের মাটির গুণগত মান বজায় রাখা ও ভেজালমুক্ত খাবার পরিবেশন করা সম্ভব হবে। এভাবে প্রতিটি গ্রাম থেকে অতিরিক্ত ফসল ও বীজ সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে রপ্তানি করে দেশের মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং শস্য আমদানি বাবদ খরচ কমানো সম্ভব হবে। যৌথভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলো বিক্রির জন্য কৃষকদের দ্বারাই সৃষ্ট বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। ফলে কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পাবে এবং ভোক্তারাও ভেজালমুক্ত পণ্যের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও লাভবান হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস পাবে।

একটা সময় ছিল অভিভাবকদের স্বপ্ন থাকত তাদের সন্তান চিকিৎসক নয়তো প্রকৗশলী হবে। কৃষির ওপর তাদের সন্তান উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে এটা তারা ভালোভাবে গ্রহণ করতেন না। কিন্তু সময় বদলেছে। কৃষিকে উচ্চশিক্ষা ও পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে আধুনিক অনেক তরুণ-তরুণীরা। এ পেশাকে বিশ্বজুড়ে বলা হচ্ছে সম্ভাবনাময় সবুজ ক্ষেত্র। সত্যি বলতে কি বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি কিছু দিয়ে থাকে তাহলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই দিয়েছে। এ পেশার সঙ্গে জড়িত কৃষিবিদ আর কৃষিবিজ্ঞানীদের কল্যাণেই দেশ আজ খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিতে পড়াশোনা করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক ভালো চাকরি পাওয়া যায়। রয়েছে দেশের বাইরে কৃষি নিয়ে কাজ করার অপার সুযোগ। সব মিলিয়ে কৃষি খাতে রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনার হাতছানি।

কৃষকরা অত্যাবশ্যকীয় নাগরিক সুবিধা ও প্রকৃত রাষ্ট্রীয় সম্মান পাবে। দেশের প্রশিক্ষিত কৃষক ও কৃষিবিদদের দ্বারা দেশের বাইরে জমি লিজ নিয়ে সেখানে চাষাবাদ করে বিশ্বে খাদ্যঘাটতি ও খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যেতে পারে। যার পদক্ষেপ হিসেবে আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে জমি লিজ নিয়ে সেখানে বীজ ও ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছে। কৃষির এই আমূল পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দেশের সমুদ্রসীমায় লবণাক্ত পানিতে হাইড্রোপনিঙ্ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক এলাকা চাষের আওতায় এনে অতিরিক্ত ফসল ফলানো সম্ভব হবে। শহরাঞ্চলের বাড়ির ছাদে ছাদে ফুল, ফল ও সবজি শোভা পাবে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করবে। গ্রামগুলোও একসময় রাস্তার দু’পাশ দিয়ে সুবৃহৎ অট্টালিকা আকারে গড়ে উঠবে এবং কৃষি জমির ওপর চাপ কমানো সম্ভব হবে। এভাবে বাংলা আবার শস্য শ্যামলে ভরপুর হয়ে তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।