বাংলাদেশের রফতানি আয় ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছেই। গত অর্থবছর শুধু ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৫০ কোটি ডলারের ঘর ছাড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে দেশের স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়নের তাগিদ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় চারটি স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সিলেটের শেওলা, সাতক্ষীরার ভোমরা, যশোরের বেনাপোল ও খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দর উন্নয়নে প্রস্তাবিত প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫৯৬ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৫ কোটি ডলার ঋণ দেবে বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪৩৩ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ১৬৩ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেকটিভিটি প্রজেক্ট: শেওলা, ভোমরা, রামগড় স্থলবন্দর উন্নয়ন এবং বেনাপোল বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পটি সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। কমিশনের বৈঠকে প্রস্তাবের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত এলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে। একনেকের অনুমোদন পেলে ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করবে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে শেওলা স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। ভারতের অংশে এর নাম সুতারকান্দি স্থলবন্দর। বন্দরটির মাধ্যমে ভারতের আসামের সঙ্গে বাণিজ্য স্থাপন সম্ভব। অন্যদিকে ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে সাতক্ষীরা হয়ে ভারতের কলকাতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হয়। এ বন্দরের ওপেন ইয়ার্ডের উন্নয়নে কাজ করা হবে প্রকল্পের আওতায়।
এতে আরও বলা হয়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে ৪০০ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ির রামগড় বন্দর উন্নয়নের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য আরও বাড়বে। এ বন্দরটির উন্নয়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরটি ভারতের ব্যবহারের উপযোগী করার কথাও ভাবছে সরকার।
তবে প্রকল্পটির প্রস্তাবনার বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আপত্তি রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের। পিইসি সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চারটি বন্দরের উন্নয়নে কাজ করার পরিকল্পনা থাকলেও ভোমরা ও শেওলা স্থলবন্দরের সম্ভাব্যতা যাচাই জরিপের প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে প্রকল্পের দলিলে। রামগড় ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়নি। তাছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ‘সাসেক রোড কানেকটিভিটি প্রজেক্ট : বেনাপোল ও বুড়িমারি স্থলবন্দর’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর আওতায় বেনাপোল বন্দরের কার্যক্রমের সঙ্গে প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় নেয়া কার্যক্রমের কোনো দ্বৈততা আছে কিনা তা জানানো হয়নি। বন্দরগুলোর মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে প্রকল্পটি সহায়ক কিনা তাও বলা হয়নি প্রস্তাবিত প্রকল্পের দলিলে। পিইসির সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা হবে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাবের বিষয়েও আপত্তি রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের। ৬ কোটি টাকা ব্যয় করে কী কাজ করা হবে তা প্রস্তাবনায় বলা হয়নি। পুনর্বাসন বাবদ ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের বিস্তাবিত বিবরণ নেই প্রস্তাবনায়। ভোমরা ও রামগড় স্থলবন্দরের সম্ভাব্যতা যাচাই ও ডিজাইনের জন্য ৯ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এ ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা, প্রকল্পের গাড়ি ভাড়া বাবদ ১ কোটি টাকা রাখা, সোশ্যাল মিটিগেশন বাবদ ২২ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়েও আলোচনা করবে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ৯৫ কিলোমিটার, মিয়ানমারের সঙ্গে ২৫৬ কিলোমিটার এবং উপকূলীয় এলাকায় ৫৮০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমারেখা রয়েছে। এসব সীমারেখার মধ্যে অনেক স্থলবন্দর রয়েছে। যেখান দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি-রফতানি হয়। এছাড়া প্রতিনিয়ত অনেক পর্যটক স্থলবন্দরগুলো দিয়ে চলাচল করে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে চারটি স্থলবন্দরের উন্নয়ন করে এসব ক্ষেত্রে সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এশিয়ার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে মধ্যে। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো পণ্য ও সেবার বহুমুখী সীমান্ত বাণিজ্য, বিনিয়োগ প্রবাহ ও মানবিক সংযোগের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার সুযোগ লাভ করে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেলেও ভারতের সঙ্গে বিরাট অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ভারতের সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ভারতের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করতে পারে। ট্রানজিট ফি এবং পরিবহন চার্জ আদায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশও ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে। সংযোগ উন্নয়নের মাধ্যমে উভয় দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে পারে।