সচেতনতা বাড়ায় উপকূলে কমেছে কচ্ছপের মৃত্যু

কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায় প্রজনন মৌসুমে কচ্ছপের মৃত্যুহার কমেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শীতকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় মা-কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। গত বছর এ সময় উপকূলে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে শত শত মা-কচ্ছপ মারা পড়েছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর প্রচারণার কারণে এ বছর জেলেদের জালে আটকে কচ্ছপ মারা পড়ার খবর এখনো পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কচ্ছপের ডিম দেয়ার সময়। সামুদ্রিক কচ্ছপ জেলি ফিশসহ নানা প্রজাতির ক্ষতিকর প্রাণীর পোনা খেয়ে বাঁচে। জেলি ফিশের সংখ্যা বেড়ে গেলে মাছের সংখ্যা কমে যায়। কচ্ছপ এ প্রাণী খেয়ে সাগরের মাছের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। কচ্ছপ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা জেলেদের কাছে তুলে ধরে ভালো ফল পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক জাহানারা ইয়াছমিন বলেন, উপকূলের সোনাদিয়া থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সাগর এলাকায় ডিম পাড়তে আসার সময় কেউ যাতে কচ্ছপ না মারে, তার জন্য আড়াই বছর ধরে সচেতন করে আসছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে জেলেদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। তবে দাপ্তরিকভাবে বর্তমানে এ কার্যক্রম বন্ধ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, চলতি বছরও অসংখ্য কচ্ছপ উপকূলে ডিম পেড়েছে। এরই মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়া শুরু করেছে। জেলার সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, বদরমোকাম, শাহপরীর দ্বীপ, বাহারছড়া, মনখালী, হিমছড়ি, প্যাচারদিয়া ও সোনাদিয়া দ্বীপের সৈকতে নিয়মিত কচ্ছপের দেখা মিলছে।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমেদ জানান, গত নভেম্বর থেকে কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসছে। তবে এ বছর এখনো কচ্ছপ মারা পড়তে দেখিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সিবিএইসিএ প্রকল্পের সাবেক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম সুমন জানান, গভীর সাগরে চিংড়ি ধরার ট্রলার ও নৌকার পুঁতে রাখা ১০ হাজারের বেশি বেহন্দি জাল এবং আট হাজারের বেশি ভাসা জালে আটকা পড়ে গত কয়েক বছরে পাঁচ হাজারের মতো কচ্ছপ মারা গেছে।
জেলেরা জানান, আগে কচ্ছপ জালে আটকা পড়লে অনেকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলত। তবে পরিবেশের গুরুত্বের কথা চিন্তা করে এখন জালে আটকা পড়লে কচ্ছপ ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।
সচেতনতা বাড়ায় কচ্ছপ শিকারও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। আগে সাগরে জাল পুঁতে ও বড়শি দিয়ে কচ্ছপ ধরত স্থানীয়রা। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা হামিদুল হক জানান, ৮-১০ বছর ধরে তিনি কচ্ছপের ডিম মিয়ানমারে বিক্রি করেছেন। গত বছর থেকে এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
সামুদ্রিক প্রাণী গবেষণা সংস্থা মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক ও কচ্ছপ বিশেষজ্ঞ জহিরুল ইসলাম জানান, দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বঙ্গোপসাগর কচ্ছপ বিচরণের মূল ক্ষেত্র। পশ্চিমে সুন্দরবন থেকে দক্ষিণ-পূর্বের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রসৈকতের বালুচরে এরা ডিম পাড়তে আসে। শীতকাল থেকে বর্ষা শুরু পর্যন্ত কচ্ছপের ডিম পাড়ার সময়। স্থান ও প্রজাতিভেদে দিন-ক্ষণ পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এখন পর্যন্ত পাঁচ প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অলিভ রিডলে, গ্রিন টারটল ও হকসিবল্ড নামের তিন প্রজাতির কচ্ছপ কক্সবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে আসে।
তবে সেন্ট মার্টিন ও সোনাদিয়ায় পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় কচ্ছপ প্রজনন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সৈকত এলাকায় শব্দদূষণ, জেনারেটর চালানো ও যানবাহনের আনাগোনা বেড়ে গেলে মা-কচ্ছপ উপকূলে ডিম পাড়তে আসবে না।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, সেন্ট মার্টিন ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ কচ্ছপের জন্য সংরক্ষিত এলাকা। এ এলাকার পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী এ ব্যাপারে সহায়তা করছে। কচ্ছপের ডিম চুরি বন্ধে সৈকতে পাহারা বসানো হয়েছে।