উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ

বর্তমান সরকার লাগাতার দুই মেয়াদে ৮ বছর পার করছে। এই সরকারের অনেক অর্জন লক্ষণীয়। বড় অর্জনটি হলো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার করা ও দণ্ড কার্যকর করা। এই অঙ্গীকারটি ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতেও ছিল। সুতরাং বলা যায়, বর্তমান সরকার তার অঙ্গীকার পূরণ করছে। এখনো অবশ্য অনেক বিচার বাকি, বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান। আমাদের আশা থাকবে বর্তমান সরকার মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই সিংহভাগ বিচারের কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে। তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দুটো ট্রাইব্যুনালের জায়গায় আরও ট্রাইব্যুনাল করলে বিচারের গতি দ্রুততর হবে। বঙ্গবন্ধু ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল করেছিলেন। বর্তমানে ৭৩টি না হলেও আরও ট্রাইব্যুনাল করা যেত। তবু আশার কথা হলো এই যে, বিচার চলমান।

বর্তমান সরকার একটি দৃষ্টান্তমূলক কৃতিত্বের অধিকারী। কৃতিত্বটি হলো বিনামূল্যে প্রায় ৩৩ কোটি বই বছরের নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া। অবশ্য বইগুলোতে ভ্রান্তি, তথ্যবিকৃতি ও আদর্শিক স্খলন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং যা এমন একটি কৃতিত্বকে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে। কেন এমন হলো, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তবে এমন একটি ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক দর্শনের অভাব, অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং ব্যবস্থাপনার ত্রুটিকে দায়ী করা যায়। অবশ্য সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত মনে হয়নি। পাঠকক্রমে ভুক্তির ক্ষেত্রে হেফাজতে এবং ওলামা লীগের সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে—এমন অভিযোগও উঠেছে। অভিযোগটি গুরুতর। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ হিসেবে দাবিদার সরকার যখন ক্ষমতাসীন, তখন এমন একটি ত্রুটি ও অভিযোগ অনাকাঙ্ক্ষিত।

পদ্মা সেতু নিয়ে অর্থায়নের আগেই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এক নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যদিয়ে বিশ্বব্যাংকের মোড়লিপনার সমুচিত জবাব দিয়েছে। পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান হবে, যা নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। পদ্মা সেতু বাঙালির স্বপ্নের সেতু এবং তা যখন বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়, তখন তা এই সরকারের একটি বড় অর্জন হিসেবেই বিবেচিত হয়।

সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক দিনের বিরোধ ছিল, কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি প্রক্রিয়ায় বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাত্ সমুদ্রে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা অর্জন করেছে। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় অর্জনটি গুরুত্বপূর্ণ।

জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশ নয়, এখন সারা বিশ্বেরই সমস্যা। কিন্তু বাংলাদেশ এই সমস্যা মোকাবিলার নিজস্ব সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছে গুলশান ও শোলাকিয়া ঘটনার সাহসী সমাধানের মাধ্যমে। অবশ্য কিছু প্রাণের ক্ষয় এড়ানো যায়নি। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান থেকেছে। যার ফলে ক্রমাগতভাবে জঙ্গি আস্তানা এবং জঙ্গি নির্মূল হচ্ছে। সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশ জঙ্গি দমনে নজরকাড়া সাফল্য অর্জন করেছে।

তবে বর্তমান সরকারের ঘাটতির কিছু দিকও আছে। বিশেষ করে নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জ ঘটনা দুটোর মধ্যদিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেছে। এর একমাত্র কারণ হিসেবে বলা যায়, সুশাসনের অভাব। অবশ্য এইসবকে ছাপিয়ে আরও উল্লেখ্য—রাজনীতির বেসামাল অবস্থা। কারণ দুটো ঘটনাতেই একাট্টা ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত। ক্ষমাতসীন আওয়ামী লীগ যে তার দলের উপরে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ তার প্রমাণ ঘটনা দুটো। অবশ্য দলীয় নিয়ন্ত্রণের অভাব আরও প্রকট হয়েছে জেলা পরিষদ নির্বাচন, কারণ নির্বাচনটি এক পেশে হলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিল; এবং বিদ্রোহী প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বিজয়ী হয়েছে।

তবে ২০১৬-এর শেষ দিকে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিতে একটি ইতিবাচক সংযোজন ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন; যা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে নন্দিত হয়েছে। তবে উল্লেখ্য নির্বাচনটি একটি শিক্ষা দিয়েছে এবং তা হলো, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব মহলের সদিচ্ছা থাকালেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য মানের হয়। আরও একটি শিক্ষা হলো, নির্বাচনে সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের বড় কথাটি হলো, সেলিনা হায়াত আইভীর ব্যক্তিগত বিজয়। কারণ নারায়ণগঞ্জের মতো একটি বিপন্ন নগরীতে এই প্রার্থীর দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান তাকে ব্যতিক্রম ভাবমূর্তি দিয়েছে। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, জনগণ ভালো ও যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করে, যা জাতীয় নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে জাতীয় রাজনীতি অসম্পূর্ণ থেকে গেছে বিরোধী মহল। কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে কখনোই আলোচ্য সময়ে নিজেদেরকে হাজির করতে পারেনি তারা। নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনটি আসলে শুধু নামমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে থেকে গেছে। অন্যদিকে সরকারও বিএনপিকে ন্যূনতম ছাড় দেয়নি। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটা একচক্রে আবর্তিত হয়েছে। জানা কথা, রাজনীতি-গণতন্ত্র দ্বিচক্রযানের মতো; কোনোটিই এক চাকায় চলে না।