বাংলাদেশ যে একটি মধ্যম আয়ের উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে চলেছে, বিষয়টি এখন আর কল্পনা বা অনুমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এ ধরনের যে সমস্ত সংস্থা রয়েছে, তাদের সকলেরই অভিমত, বাংলাদেশ সামনের পাঁচ বছরের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারও তাদের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে—২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ বলে বিবেচিত হবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে। বাংলাদেশ সরকারের এ আশাবাদের মধ্যে যুক্তি ও তথ্য আছে। আমরা সে তথ্যের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করতে পারি।
আমরা জানি, একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটে। বাংলাদেশে তেমনটি ঘটতে শুরু করেছে। ২০০৮ সালের শেষ ভাগে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। মোটামুটি এই সরকারের শাসনকাল ৮ বছর মতো হবে। ৮ বছর আগে বাংলাদেশ এমনকি বিশ্বের কোনো দেশ ভাবতেও পারেনি ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্য আয়ের দেশ বলে পরিচিতি পাবে। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পরপরই রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে; যার ফলে দিন দিন দেশের মাথাপিছু আয় বাড়তে থাকে, দেশের অর্থনীতি দিন দিন চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুত্, কৃষি এবং অন্যান্য সেক্টরে উন্নয়নের হাওয়া বইতে থাকে। আমাদের দেশে একটি নীতিবাক্য প্রচলিত আছে—শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি যদি শিক্ষার উন্নয়ন না ঘটে, সে অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থায়ী রূপ পেতে পারে না। তবে আশার কথা, আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নতি সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছে। এ মুহূর্তে আমরা শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে একটু দৃষ্টি দিতে পারি। গত এক দশকে শিক্ষার সর্বস্তরেই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষার এই ব্যাপক অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকেও মজবুত করে তুলেছে। আলোচনা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করা যেতে পারে। বর্তমান সরকার তার ৮ বছরের শাসনকালে দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাত্পর্যপূর্ণ সাফল্য। ৮ বছর আগে যেখানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ, বর্তমানে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় শতভাগ। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির হার ছিল ৫১ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশ। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির হার ছিল ৩৩ শতাংশ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৪৪ শতাংশ।
যে জাতি নারীদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে পারে, সে জাতির উন্নতি অবধারিত। বর্তমান সরকার শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশে শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। একসময় নারী শিক্ষা ছিল শুধু উচ্চবিত্ত ও শহরের কিছু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। প্রায় শতভাগ মেয়েই এখন স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ে যে পরিবেশ থাকা দরকার, সরকার তা নিশ্চিত করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রথম স্থানে অবস্থান করছে।
শিক্ষা খাতে বাজেট :মানবসম্পদ ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে সুযোগের পাশাপাশি সম্পদেরও প্রয়োজন। চলতি অর্থবছরে সরকার জাতীয় বাজেটের ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে শিক্ষা খাতে। টাকার অঙ্কে যা আগের বছরের তুলনায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা।
পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধে প্রতিথযশা ইতিহাসবিদদের নিয়ে সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজন করেছে সরকার। ফলে বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় বীরদের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে।
মাদ্রাসা শিক্ষায় আধুনিকায়ন :বর্তমান সরকার মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করেছে। সাধারণ শিক্ষার অনুরূপ মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শাখা চালু করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় বিদ্যমান সমস্যার সমাধান ও আধুনিকায়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপিত হচ্ছে। তাছাড়া দেশে একটি ইসলামি-আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষা দেখভাল করার জন্য মূল দায়িত্ব পালন করে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। দেশে উচ্চশিক্ষার পরিধি প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে, গড়ে উঠছে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৫ সালে এসে দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১২৩টি। ক্রমবর্ধমান চাহিদার আলোকে ২০১৬ সালে আরও কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষাঙ্গনে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। ২০০৯ সালের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের সেশন জট ছিল, আজ তা নেই বললেই চলে। প্রতি বছর সময়মতো ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, নিয়মিত ক্লাস চলছে এবং যথাসময়ে তারা ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখা বর্তমান সরকারের বড় রকমের সাফল্য।
অব্যাহতভাবে এ কাজ চলতে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু একটি মধ্যম আয়ের দেশ হবে না, শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ একটি মধ্যমানের শিক্ষিত দেশ বলে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে।