গতি পেয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন

উত্তরের জেলাগুলোতে এখন ভোর শুরু হয় কর্মচাঞ্চল্যে। ভোরে রবি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটছে কর্মস্থলে। অন্যদিকে, সাতসকালে তাদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে দৈনিক পত্রিকা। রাতদিন স্যাটেলাইট টিভির সংবাদ আর বিনোদনে বেশ আছেন সেখানকার মানুষজন। ইপিজেড হয়েছে, শিল্পকারখানা হচ্ছে একের পর এক। কর্মী তো লাগবেই। শুনে বিস্ময়কর মনে হলেও এটিই এখন বাস্তবতা। আর যারা কাজ করতে পারছেন না নানা কারণে, যেমন মাতৃত্বজনিত কারণে। তাদেরও ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে। বয়স্ক, দুস্থ, অসহায়, অক্ষম—সেও দৃষ্টির বাইরে নয়। তারও রয়েছে মাসিক ভাতার ব্যবস্থা। যেখানে মঙ্গার কবলে নিপীড়িত মানুষদের নিয়ে আহ্, উহ্ কত দুঃখবোধ ছিল শহুরে দরদিদের, কিন্তু অবহেলিত এসব মানুষের প্রকৃত দরদি হয়েছেন একজন। তিনি প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের টানা আট বছর পার করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দারিদ্র্যজয়ের স্বপ্ন নিয়ে নেওয়া তার কর্মসূচিগুলো শুধু উত্তরেই নয়, সারাদেশেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। যোগাযোগ, অবকাঠামো, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে গত আট বছরে নেওয়া পদক্ষেপ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০০৮ সালের ৬৮৬ ডলার থেকে বেড়ে এখন ১৪৬৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ৬ শতাংশে স্থির থাকা অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে এখন প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ২০১৯ সাল নাগাদ এটি ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন আকাশচুম্বী। এই রিজার্ভ ২০০৮ সালে ছিল ৬১৪ কোটি ডলার। এখন তিন হাজার দু শ কোটি ডলার। অথচ একসময় বাংলাদেশ তিনমাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ ধরে রাখতে হিমশিম খেয়েছিল।

শিল্প ও রপ্তানি খাতে দেওয়া নানা প্রণোদনার কারণে বেড়েছে রপ্তানি আয়। ব্যাংক ঋণের সুদহারও আগের তুলনায় কমেছে। দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে উদ্যোক্তাদের জন্য জেলায় জেলায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজেও হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে।

মধ্য আয়ে দেশ

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৬ ডলারে। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৩১৬ ডলার। আয় বাড়ায় এ বছর বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। শীঘ্রই মধ্য আয়ের মধ্যসারিতে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে এরমধ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

আলোচ্য সময় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্বস্তিও ছিল জনমনে। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক অর্থায়নের কারণে মুদ্রা সরবরাহ বাড়লেও কার্যকর কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের নভেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা আগের মাস অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বছরের শুরুতে (জানুয়ারি) মূল্যস্ফীতির এ হার ছিল ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে মূল্যস্ফীতির হার ছিল সোয়া ৭ শতাংশের মতো।

মানবসম্পদ

উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার আর্থ-সামাজিক খাতে বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ হারে ব্যয় করছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আলোকে সরকার স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। অপুষ্টির হারও কমেছে। ফলে, শ্রমশক্তিতে যোগ হয়েছে কর্মক্ষম তারুণ্য।

দারিদ্র্য বিমোচন

২০০৫ সালে দেশে যেখানে ৪০ ভাগ মানুষ দরিদ্র ছিল সেখানে বর্তমানে এই হার ২৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অতিদরিদ্র্য মানুষের হার নেমে এসেছে ১২ শতাংশে নিচে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকার বাজেটের ১২ দশমকি ৭২ ভাগ ব্যয় করছে। দেশের দারিদ্য্র বিমোচনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার, ঘরে ফেরা, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ, বিভিন্ন ধরনের ভাতা, কর্মসৃজনী প্রকল্প, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বেসরকারি খাত উন্নয়ন

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নে পৃথকভাবে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণে ইতিমধ্যে একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের কাজ এগিয়েছে। বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। শিল্প স্থাপনে জমির সংকট কাটাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত, খাস জমি এবং চরাঞ্চলে গড়ে তোলা হচ্ছে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল। পাশাপাশি দেশে গত কয়েক বছরে মোবাইল ব্যাংকিংসহ ই-কমার্সের প্রসার ছিল উল্লেখযোগ্য। দেশের ই-কমার্স প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের বিশ্বস্বীকৃতি মিলেছে। পরিবেশ উন্নয়নে মিলেছে চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ পুরস্কার। পরিবেশ উন্নয়ন ছাড়া এখন টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবাই যায় না। এমডিজি অর্জনে যেমন জাতিসংঘের প্রশংসা মিলেছে, এসডিজির ক্ষেত্রেও তেমটি প্রত্যাশা অতিস্বাভাবিক।

কৃষি, অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতের উন্নয়নও অব্যাহত গতিতে রয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে নতুন ইমেজ সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে। উন্নয়নের এই গতি ধারা অব্যাহত থাকলে স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন অবধারিত।

গত আট বছরে জাতীয় বাজেট চিত্র

২০০৯-১০ ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি

২০১০-১১ ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা

২০১১-১২ ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি

২০১২-১৩ ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি

২০১৩-১৪ ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি

২০১৪-১৫ ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা

২০১৫-১৬ ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা

২০১৬-১৭ ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা