চোখ জুড়ানো উন্নয়ন কৃষিখাতে

সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। গত টানা আট বছর ধরে দেশের সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। এ লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারযোগ্য খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রাসায়নিক সারের দাম দফায় দফায় কমিয়ে নিয়ে আসা হয় কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। পানি সেচার জন্য ব্যবহূত বিদ্যুতের উপর চালু করা হয় ভর্তুকি। ৩০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয় কৃষি যন্ত্রপাতির। মোট বাজেটের প্রায় সাড়ে চার শতাংশ ব্যয় করা হয় কৃষি ভর্তুকি খাতে। তাছাড়া দ্রুত হ্রাস করা হয় কৃষি ঋণের সুদের হার। তাতে কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির ধারণ ও বিকাশ উত্সাহিত হয়। পানি সেচের আওতা বৃদ্ধি পায় মোট আবাদি জমির প্রায় ৭০ শতাংশে। উচ্চ ফলনশীল জাতের আওতায় আসে প্রায় ৮০ শতাংশ ধানি জমি। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পায় খাদ্যশস্যের উত্পাদন। ২০০৮-০৯ সালে এ দেশে মোট খাদ্যশস্যের উত্পাদন ছিল ৩৩৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা ৩৯০ লাখ মেট্রিক টনে বৃদ্ধি পায়। গমের উত্পাদন বৃদ্ধি পায় ৯ লাখ থেকে ১৪ লাখ মেট্রিক টনে। ভুট্টার উত্পাদন ১৪ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে গিয়ে ২৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়ায়। চিরকালের খাদ্য ঘাটতির দেশ পরিণত হয় খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে। বিশ্ব-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খাদ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে।

দানাদার খাদ্যশস্যের পর আলুর উত্পাদনে বিপুল উদ্বৃত্ত অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। দেশের মানুষের দৈনিক জনপ্রতি আলুর চাহিদা হচ্ছে ৭০ গ্রাম। আমাদের দৈনিক প্রাপ্যতা জনপ্রতি প্রায় ১৭০ গ্রাম। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকে আলুর মোট উত্পাদন ছিল প্রায় অর্ধ কোটি মেট্রিক টন। এখন তা এক কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আলু রপ্তানি করে আমাদের আয় হয়েছে ১০০ কোটি ডলার। তাছাড়া আলুর উত্পাদন বৃদ্ধির সঙ্গে এর ব্যবহারও বহুমুখী হচ্ছে। আগে আলুর ব্যবহার হতো মূলত সবজি হিসেবে। এখন তা চিপ্স ও পটেটো ক্রেকার্স হিসেবে অনেক সমাদৃত। ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সবজি উত্পাদন প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন ও ভারতের পর বিশ্বে সবজি উত্পাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মৌসুমের শুরুতে বাজারে সবজির দাম ভালো থাকায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবজির রপ্তানি সম্প্রসারিত হওয়ায় দেশের কৃষকরা সবজি চাষে বেশ উত্সাহিত হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন আধুনিক সবজি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলছে বড় সবজি খামার। মত্স্য খাতে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মোট উত্পাদন ছিল প্রায় ২৫ লাখ টন। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে তা ৩৮ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। মত্স্য খাতের বর্তমান গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ। হিমায়িত খাদ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এ খাতের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ি রপ্তানি থেকে প্রতিবছর আমাদের আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ইলিশের উত্পাদনে সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো। এবার বাজারে ইলিশ মাছের সরবরাহ থাকায় বেশি দাম ছিল সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে। ধনী, দরিদ্র সবাই এর স্বাদ নিতে পেরেছে। সরকার ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধ করণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উত্পাদন বিপুল পরিমাণে বেড়েছে।

কৃষিখাতে পুঁজি গঠনে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর। ২০০৮-০৯ সালে এদেশে বিতরণকৃত মোট কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কৃষিঋণের সুদের হার নামানো হয়েছে ১০ শতাংশে। মসলা জাতীয় ফসলের জন্য ঋণ দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে। দুগ্ধ খামার গড়ার জন্য ঋণের সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশে। এছাড়া পোল্ট্রি ও মত্স্য খামার গড়ার জন্যও প্রদান করা হচ্ছে উদার ঋণ সুবিধা। তাছাড়া কৃষি বিপণন ও কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়েও ঋণের বিশেষ সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম দুটো প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল বর্তমান সরকারের ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণের পর। এর জন্য ১০ টাকা জমার বিনিময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা হয়েছিল কৃষকদের জন্য। তার সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি। ওই সময় কৃষকদেরকে নগদ সহায়তা প্রদানও করা হয়েছিল।

কৃষিপণ্যের মূল্যে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা বর্তমান সরকারের একটি চমত্কার সাফল্য বলে অভিহিত করা যেতে পারে। গত পাঁচ বছরে কোনো পণ্যেরই দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়নি কিংবা একদমই নিচে নেমে গিয়ে কৃষকদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। তাছাড়া কৃষিপণ্যের অঞ্চলভিত্তিক মূল্য পার্থক্য ছিল কম। গত মৌসুমে প্রায় সমান পরিমাণে ধান ও চাল সংগ্রহ করা হয়েছিল কৃষকদের কাছ থেকে। তাতে বোরো ধানের বাজার দর ছিল ভালো। এবারের আমন মৌসুম শুরুর আগে আমদানিকৃত চালের উপর শুল্ক বসানো হয়েছিল ২০ শতাংশ হারে। তাতে চালের আভ্যন্তরীণ বাজারে ছিল তেজি ভাব। এবার অপেক্ষাকৃত সস্তা দামে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হয়নি। ফলে আমন ধানের মৌসুমে তেমন মূল্য হ্রাসের ঘটনা ঘটেনি। ফলে এখন ধান-চালের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে কৃষক। কোথাও কোনো দরপতন বা লোকসানের খবর শোনা যাচ্ছে না কৃষকদের পক্ষ থেকে। এটা সরকারি নীতিরই সুফল। পাটের ক্ষেত্রে এবার বাজার দর ছিল কৃষকদের অনুকূলে। নিদেনপক্ষে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে কৃষকের পাট। তাতে লাভবান হয়েছে কৃষক।

কৃষি খাতের উত্পাদন বৃদ্ধি ও কৃষিপণ্যের মূল্যে স্থিরতা আসায় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ক্রমাগতভাবেই কমে আসছে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার। অপর দিকে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে। এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে একজন কৃষি শ্রমিকের প্রত্যাশা ছিল এক দিনের কাজের বিনিময়ে সাড়ে ৩ কেজি চাল। এখন এক দিন কাজ করে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায়, তা দিয়ে একজন কৃষি শ্রমিক প্রায় ১০ কেজি চাল কিনতে পারে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচি চালু থাকায় স্বস্তিতে রয়েছে গরিব মানুষ। হ্রাস পেয়েছে দারিদ্র্য।