পাটের সুদিন ফেরাতে লড়ছেন আহসান

নাসিমূল আহসান। ৩০ বছরের এক টগবগে যুবক। পাটপণ্য মেলায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় পাটপণ্যের প্রেমে পড়ে যান। সেই থেকে শুরু। পাটপণ্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও পাটশিল্পের উন্নয়নে গড়ে তুলেছেন ‘পাটের লড়াই’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কৃষকদের নিয়ে, পাটপণ্য নিয়ে কাজ করেন এমন তিন হাজার মানুষকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘পাটবন্ধু’ নামের একটি ফোরাম।

পাটপণ্য ব্যবহারে মানুষকে উত্সাহী করতে তৈরি করেছেন একটি অনলাইন তথ্য কেন্দ্র, যেখানে নিয়মিত পাটসংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ, ফিচার ও তথ্য প্রকাশিত হয়। পাটপণ্য উদ্যোক্তা গ্রামীণ নারীরা যাতে সহজে তাদের উত্পাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারেন, সেজন্য ‘ইউজুট’ নামে বাংলাদেশের প্রথম পাটপণ্যের অনলাইন মার্কেটপ্লেস তৈরির কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন।

নানা সমস্যা সত্ত্বেও বাংলার তৈরি বহুমুখি পাটপণ্য বিশ্বের ১১৮টি দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই সম্ভাবনা আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে নাসিমুল আহসান জানান, গ্লোবালি পাটপণ্যের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে পাটশিল্প নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। বহুমুখি পাটপণ্যের গুণগত মান, দেশ ও দেশের বাইরে এর ব্র্যান্ডিং ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে। দেশের সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পাটপণ্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসলে পাটশিল্প খুব দ্রুত সামনে এগিয়ে যাবে।

বহুমুখি পাটপণ্য উত্পাদন ও রপ্তানি নিয়ে নাসিমুলের বক্তব্য, আমাদের এখন আর কেবল পাটপণ্য তৈরি করলেই চলছে না। এর ডিজাইন, বৈচিত্র্য, বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগিতাও এখন যাচাই করার সময় এসেছে। পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগের বিষয়টি এখন দরকারি হয়ে উঠেছে। এছাড়া আমাদের পাটখাতের সমস্যা, সুবিধাগুলো আরো নিবিড়ভাবে দেখার, বোঝার পরিসর তৈরি করার বিষয়টিও সামনে উঠে আসছে।

‘পাটবন্ধু’ পরিবার নিয়ে নাসিমুলের অনেক স্বপ্ন। কৃষকের সাধারণ সমস্যা থেকে পাটপণ্যের সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, সব বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা হয় এই ফোরামে। ইতিমধ্যে নতুন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অভিজ্ঞ পাটপণ্য উত্পাদক ও রপ্তানিকারকের সংযোগ স্থাপনের জন্য ‘পাটপণ্য উদ্যোক্তা পরামর্শক সেল’ তৈরি করেছেন, যেখানে পাটপণ্য উত্পাদনে আগ্রহী যে কেউ বিনামূল্যে তথ্য সেবা পেয়ে থাকেন।

ই-কমার্সের মাধ্যমে দেশব্যাপী ক্রেতাদের কাছে পাটপণ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্প্রতি ‘ইউজুট’ নামে শুধুমাত্র পাটপণ্যের একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস তৈরির কাজ হাতে নিয়েছেন। নাসিমুল জানান, গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা পাটপণ্য তৈরি করছেন কিন্তু সেসব পণ্য বিক্রির কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। আবার যারা পাটপণ্য কিনতে আগ্রহী, তারাও সবসময় দরকারি পাটপণ্য খুঁজে পান না। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতেই মূলত বাংলাদেশের প্রথম পাটপণ্যের অনলাইন মার্কেটপ্লেস করা।

রপ্তানির পাশাপাশি দেশে পাটপণ্যের একটি বড় বাজার আছে বলে মনে করেন নাসিমুল। দেশের মানুষকে পাটপণ্য ব্যবহারে উত্সাহিত করার পাশাপাশি তাদের হাতে কমমূল্যে দৃষ্টিনন্দন পাটপণ্য পৌঁছে দিতে পারলে স্থানীয় বাজারও বহুমুখি পাটপণ্যের জন্য একটি দারুণ সম্ভাবনার জায়গা হয়ে উঠতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পাটপণ্যকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। তার মতে, দেশজুড়ে অসংখ্য উদ্যোক্তা বাহারি সব ডিজাইনের পাটপণ্য তৈরি করছেন নিয়মিত। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ক্রেতার কাছে সেই পণ্যের তথ্য পৌঁছায় না অনেক সময়। এক্ষেত্রে পাটপণ্যকে জনপ্রিয় ও ক্রেতার ক্রয় চাহিদা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া। পাশাপাশি প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোও নিয়মিত নানা ধরনের পাটপণ্য নিয়ে ফিচার প্রকাশ করেও পাটপণ্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে কাজ করতে পারে বলে জানান নাসিমুল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন নাসিমুল। স্নাতকে হয়েছেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে। গত বছর একুশে বইমেলায় নাসিমুল লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বইমেলায় একইসাথে ‘গোলাপ মেয়ের সাথে স্বর্গযাত্রা’ (উপন্যাস) ও ‘রোদের কাছে চিঠি’ (কাব্যগ্রন্থ) নামের দুটি বই প্রকাশিত হয়। পলল প্রকাশনী ও রাঁচী গ্রন্থনিকেতন বই দুটি প্রকাশ করে।

পাটের প্রতি ভালোবাসা ও একজন নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি সামাজিক দায়িত্বের জায়গা থেকে পাটের এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নাসিমুল। তিনি জানান, প্রত্যেক নাগরিকের উচিত তার দেশের জন্য কিছু না কিছু করা। আমি পাটকে বেছে নিয়েছি। পাটই আমার ধর্ম। প্রায় চার কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাই পাটশিল্পের সুদিন ফেরাতে পারলে এর সঙ্গে জড়িত সবার ভালো হবে। সেই ভালোর জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

নাসিমুল আরো বলেন, পাট এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে অবহেলিত সেক্টর। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে পরিবেশবান্ধব পৃথিবী গড়ার যে প্রত্যয় দেখা যাচ্ছে গোটা পৃথিবীতে, সে জায়গায় দাঁড়িয়ে পাটই হয়ে উঠতে পারে আমাদের সম্ভাবনার বাতিঘর।