আসছে ১২ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের এই মেয়াদের তিন বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এর আগের মেয়াদের সঙ্গে যুক্ত করে বর্তমান সরকার সাফল্যের কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোথায় বা ঘাটতি রয়েছে তা নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক কোন কোন খাতে অংশীদারিত্ব হিসেবে সরকারের সঙ্গে কাজ করবে তারও একটি কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেছে এই প্রতিবেদনে।
বিশ্বব্যাংক মনে করে বাংলাদেশ এই কয়েক বছরে বেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দারিদ্র্য নিরসন, মাতৃমৃত্যু হার। এই দুটি খাতে যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তাতে অনেক ক্ষেত্রে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশটি নি¤œআয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে এসে মধ্য আয়ের দেশে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে সূচকগুলো ইতিবাচক থাকা প্রয়োজন তা পূরণে অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ বিশ্বব্যাংকের।
বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ তথা এই বর্তমান সরকার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে এটা অব্যাহত রাখতে হবে। একইভাবে মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ভালো ফলাফল দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এটি আরো উন্নত করতে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের। একইভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করার পরামর্শ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ব্যবসা-বাণিজ্যের ভালো পরিবেশ তৈরি করার আবেদন রয়েছে। অর্থাৎ ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে প্রথমেই বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান তুলে ধরেছে। তারা মনে করে, বাংলাদেশ এমন স্থানে অবস্থান করছে, যেখানে তার আশপাশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে। এর এক দিকে যেমন সুফল রয়েছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকেও রেহাই নেই। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রতিনিয়ত ঝড়, বন্যা, জ্বলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। এর ফলে অগণিত মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি ফসল আর গবাদিপশুর ক্ষতি হচ্ছে। তবে সরকারের প্রচেষ্টায় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার উদ্যোগের কমতি নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করে বাংলাদেশ পল্লী অঞ্চলে তার উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে। যার প্রভাব পড়ছে দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা দারিদ্র্য নিরসনে অনেক ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ দারিদ্র্য নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে। আর এর জন্য বেশ কিছু আলাদা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বর্তমান সরকার মানবসম্পদকে একটি গুরত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে মনে করে। যে কারণে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ নি¤œ মধ্যআয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার প্রমাণ এখন মানুষের মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২২০ ডলার। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার এখন ৭ শতাংশের কাছাকাছি। পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। যার অবস্থান হচ্ছে দ্বিতীয়। তবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে রাজস্ব আদায়ের মাত্রা এখনো প্রশ্নের মুখে রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তার অর্থ বছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ হলো, অধিক মাত্রায় রাজস্ব আহরণ করা। যেখানে রাজস্ব নীতি, প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে সম্ভব বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে এডিপি বাস্তবায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বিশেষ করে গুণগতমানের প্রকল্প নির্বাচন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়া। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরামর্শ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পুষ্টিহীনতা কমানো। এর পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ রয়েছে বিশ্বব্যাংকের।
‘ডুয়িংবিজনেস’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বিশ্বব্যাংক। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল না। এরপর এই প্রতিবেদনে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ আরো ভালো করার পরামর্শ দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেসব স্থানে এখনো দুর্বলতা রয়েছে তা কাটিয়ে উঠার জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের। যে কাঠামো ব্যবসাবান্ধব হবে। বাংলাদেশের জন্য আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। একই সঙ্গে দারিদ্র্য কমানো। কারণ শ্রম বাজারে যেভাবে জনবল আসছে তা মোকাবিলার জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে কর্মসংস্থার ব্যবস্থা করা। বিনিয়োগের মাধ্যমে তা অনেক ক্ষেত্রে লাঘব করা সম্ভব বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা।
সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। আর তা অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ এই সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। অন্যান্য অগ্রাধিকারের মধ্যে সরকারকে জ্বালানি, আইল্যান্ড কানেকটিভিটি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, নগরায়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন বলে মনে বিশ্বব্যাংক। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো, বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বহুমুখিতা পথ অবলম্বন করা, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের। অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঢাকা-চটগ্রামের হাইওয়ে উন্নত করে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের করিডর ব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ রয়েছে এই প্রতিবেদনে। উন্নত দেশে পৌঁছানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ হচ্ছে, ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের চাকরির আরো সুযোগ বাড়ানো। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এর বহুমুখিতা বাড়ানোর পরামর্শ রয়েছে। দেশের পানি ও জমিকে আরো সুসংহত করার মাধ্যমে এর ব্যবহার করা হবে সরকারের একটি লক্ষ্য, যা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সঙ্গে যোগ করবে রফতানির নতুন মাত্রা।
নগরায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ হলো, দরিদ্রদের বসবাসের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা। নগরের পরিবেশ দূষণ কমানোর ক্ষেত্রেও তাগিদ রয়েছে বিশ্বব্যাংকের। সামাজিক সুরক্ষা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য পরামর্শ রয়েছে এই প্রতিবেদনে। তবে বিশ্বব্যাংক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সরকারকে কিভাবে কোথায় সহায়তা করতে চায় তার একটি কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনের প্রতিটি অধ্যায়ে।